আব্দুল্লাহকে চিঠি লিখে নয়ীম ঘরের খবর জানবার চেষ্টা করলেন। বহুদিন সে চিঠির জওয়াব মিললো না। নয়ীম ইনতেহার করতে করতে অধীর হয়ে তিন মাসের ছুটি নিয়ে গেলেন বসরার দিকে। নার্গিস তখনো তার সাথে। তাই সফরে বিলম্ব হলো। ঘরে পৌঁছে তিনি জানলেন, আব্দুল্লাহ খোরাসানে চলে গেছেন। উযরাকেও নিয়ে গেছেন সাথে। নয়ীম খোরাসান যেতে চাইলেন, কিন্তু স্পেনের উত্তর দিকে ইসলামী ফউজের অগ্রগতির কারণে তিনি নিজের ইরাদা মুলতবী রেখে ফিরে গেলেন নিরুপায় হয়ে।
১৫. দিন আসে, দিন যায়
পনেরো
দিন আসে, দিন যায়………….।
এমনি করে কতো মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মিশে যায় অতীতের কোলে। নয়ীম দক্ষিণ পর্তুগালের শাসনকর্তার পদ গ্রহণের পর কেটে যায় আঠারো বছর। তার যৌবন চলে গিয়ে আসে বার্থক্য। কালো দাড়ি সাদা হয়ে আসে। নার্গিসের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু তাঁর দেহ-সৌন্দর্যে নেই।
তাদের বড় ছেলে আব্দুল্লাহ বিন নয়ীম পনেরো বছরে পা দিয়ে ভর্তি হয়েছেন স্পেনের ফউজে। তিন বছরে মধ্যেই তাঁর খ্যাতি এমন করে ছড়িয়ে পড়েছে যে, বাহাদুর পুত্ররত্নের গর্বে ফুলে ওঠে নার্গিস ও নয়ীমের বুক। দ্বিতীয় পুত্র হোসেন বড়ো ভাইয়ের চাইতে আট বছরের ছোট।
একদিন হোসেন বিন নয়ীম বাড়ির আঙিনায় এক কাঠের ফলককে লক্ষ্যস্থল বানিয়ে তীরন্দাযীর অভ্যাস করছে। নার্গিস ও নয়ীম বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন তাদের জিগরের টুকরার দিকে। হোসেনের কয়েকটি তীর নিশানায় লাগলো না। নয়ীম হাসিমুখে হোসেনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হোসেন লক্ষ্য স্থির করে বাপের দিকে তাকিয়ে নিশানা করলো।
‘বেটা, তোমার হাত কাঁপছে আর তোমার গদান উঁচু করে রেখেছে।
আব্বাজান, আপনি যখন আমার মতো ছিলেন আপনার হাত কাঁপতো না?
‘তোমার বয়সে আমি উড়ন্ত পাখীকে যমিনে ফেলে দিয়েছি, আর যখন আমি এর চাইতে চার বছরের বড় ছিলাম তখন আমি বসরার ছেলেদের মধ্যে সব চাইতে বড়ো তীরন্দাষ বলে নাম করেছিলাম।’
আব্বাজান, আপনি নিশানা লাগিয়ে দেখুন না।’
নয়ীম তার হাত থেকে ধনুক নিয়ে তীর চালালে তীরটি গিয়ে লাগলো লক্ষ্যের ঠিক মাঝখানে। তারপর তিনি পুত্রকে নিশানা লাগাবার তরিকা বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। নার্গিসও এসে দাঁড়ালেন তাঁদের কাছে।
এক নওজোয়ান ঘোড়া ছুটিয়ে এসে দাঁড়ালেন বাড়ির ফটকে। নওকর ফটক খুললো। সওয়ার ঘোড়ার বাগ নওকরের হাতে দিয়ে ছুটে গিয়ে ঢুকলেন বাড়ির আঙিনায়।
নয়ীম পুত্র আব্দুল্লাহকে দেখে তাকে বুকে চেপে ধরলেন। নার্গিস হাজারো দোআ-ভরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে কাছে এসে বললেন, বেটা, তুমি এসেছো? আলহামদুলিল্লাহ।’
নয়ীম জিজ্ঞেস করলেন, “কি খবর নিয়ে এলে বেটা?
আব্দুল্লাহ বিন নয়ীম মাথা নত করে বিষণ্ণ মুখে বললেন, ‘আব্বাজান, কোনো . ভালো খবর নেই। ফ্রান্সের লড়াইয়ে কঠিন ক্ষতির স্বীকার করে ফিরে এসেছি আমরা ফ্রান্সের অনেকগুলো এলাকা আমরা জয় করে প্যারীস নগরীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন খবর পেলাম, ফ্রান্সের রাজা একলাখ ফউজ নিয়ে মোকাবেলা করতে আসছেন আমাদের। আমাদের ফউজ আঠারো হাজারের বেশী ছিলো না। আমাদের সিপাহসালার ওকবা কর্ডোভা থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠালেন, কিন্তু সেখান থেকে খবর এলো যে, মারাকেশে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে এবং ফ্রান্সের দিকে বেশি সংখ্যক ফউজ পাঠানো যাবে না। নিরুপায় হয়ে আমরা ফ্রান্সের রাজকীয় বাহিনীর মোকাবিলা করলাম এবং আমাদের অর্ধেকের বেশী সিপাহী ময়দানে ভূপাতিত হলো।’
আর ওকবা এখন কোথায়?’ নয়ীম প্রশ্ন হলো।’. :
‘তিনি কডোভায় পৌঁছে গেছেন এবং শিগগীরই মারাকেশের দিকে অগ্রসর হবেন। বিদ্রোহের আগুন মারাকেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে তিউনিসের দিকে। বাবার বাহিনী তামাম মুসলমান হাকীমকে কতল করে ফেলেছে। জানা গেছে যে, এ বিদ্রোহের খারেজী ও রোমীয়দের হাত আছে।’
নয়ীম বললেন, ওকাবা এক বাহাদুর সিপাহী বটে, কিন্তু যোগ্য সিপাহসালার নয়। আমায় ফউজের নেবার জন্য আমি স্পেনের ওয়ালীকে লিখেছিলাম, কিন্তু তিনি মানলেন না।’
আচ্ছা আব্বাজান, আমায় এযত দিন।’
‘এযায়ত! কোথায় যাবে তুমি’? নার্গিস প্রশ্ন করলেন।
‘আম্মিজান, আপনাকে ও আব্বজানকে দেখে যেতেই শুধু এসেছিলাম। ফউজের সাথে আমায় যেতে হবে মারাকাশের দিকে।
আচ্ছা খোদা তোমায় হেফাযত করুন। নয়ীম বললেন।
‘আচ্ছা আম্মি, খোদা হাফিয!’ বলে আব্দুল্লাহ হোসেনকে একবার বুকের সাথে লাগিয়ে তেমনি দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে চলে গেলেন। বার্বারদের বিদ্রোহের হাজার হাজার মুসলমানের প্রাণহানি হলো। তারা মুসলমান হাকীমদের হত্যা করে স্বাতীনতা ঘোষণা করলো।
ওকবা মারাকেশের উপকূলে অবতরণ করলেন এবং ১২৩ হিজরীতে শাম থেকে কিছুসংখ্যক ফউজ পৌঁছলো তাঁর সাহায্যের জন্য। মারাকাশে ঘোরতর লড়াই হলো। বাবার সেনাবাহিনী চারদিক থেকে বেরিয়ে এলো সয়লাভের মতো। হিস্পানিয়া ও শামের সেনাবাহিনী ভীষণভাবে তাদের মোকাবিল করলো, কিন্তু অগণিত প্রতিদ্বন্দ্বী ফউজের সামনে তারা টিকতে পারলেন না। ওকবা লড়াইয়ের ময়দানে শহীদ হলেন এবং মুসলিম ফউজের মধ্যে দেখা দিলো বিশৃংখলা। বার্বারবা চারদিক থেকে বেষ্টন করে তাদেরকে কতল করতে লাগলো।