নয়ীম ও আলুসের ওয়ালী পরস্পর আলাপ আলোচনা করতে লাগলেন। এক সিপাহী এসে বললো, মুফতিয়ে আযম আপনার সাথে দেখা করতে চান।
ওয়ালী বললেন, তাঁকে তশরীফ আনতে বলো।’
আপনার সাথে হয়তো তার দেখা হয়নি। নয়ীকে লক্ষ্য করে ওয়ালী বললেন, ‘এক মাসের বেশী হয়নি তিনি এখানে এসেছেন। তাঁকে আমীরুল মুমেনিনের প্রিয়পাত্র মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার আফসোস, এ পদের যোগ্য নন তিনি।’
তার নাম কি?
ইবনে সাদেক।’ ওয়ালী জওয়াব দিলেন।
নয়ীম চমকে উঠে বললেন, ইবনে সাদেক!
‘আপনি তাঁকে চেনেন?
এরই মধ্যে ইবনে সাদেক ভিতরে প্রবেশ করলো। তাকে দেকে নয়ীমের মনে হলো যেনো এক নতুন মুসীবৎ আসন্ন।
ইবনে সাদেকও তার পুরানো প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে অন্তজ্বালা অনুভব করলো।
‘আপনি এঁকে জানেন না’? ওয়ালী বললেন ইবনে সাদেককে লক্ষ্য করে, এর নাম যোবায়ের। আমাদের ফউজের সব চাইতে বাহাদুর সালার।
‘বে-শ। বলে ইবনে সাদেক নয়ীমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, কিন্তু নয়ীম মোসাফেহা করলেন না।
নয়ীম ইবনে সাদেককে আমল না দিয়ে ওয়ালীকে বললেন, আপনি আমায় এযাযত দিন।’
‘একটু দেরী করুন। আমি সিপাহসালারকে হুকুমনামা লিখে দিচ্ছি। আপনার সাথে যতো ফউজের দরকার, তিনি রওয়ানা করে দেবেন। আর আপনিও তশরীফ রাখুন।’ তিনি ইবনে সাদেককে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন। ইবনে সাদেক তার পাশে বসলে তিনি কাগজ নিয়ে হুকুমনামা লিখে নয়ীমের হাতে দেবার জন্য হাত বাড়ালেন।
‘আমি একবার দেখতে পারি কি?’ ইবনে সাদেক বললেন।
‘খুশীর সাথে।’ বলে ওয়ালী হুকুমনামা ইবনে সাদেকের হাতে দিলেন। ইবনে সাদেক তা পড়ে ওয়ালীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, এখন আর এ ব্যক্তির খেদমতের প্রয়োজন নেই। এর জায়গায় আর কোনো লোককে পাঠিয়ে দিন।
ওয়ালী হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলেন, এঁর সম্পর্কে আপনার সন্দেহ হলো কি করে? উনি হচ্ছেন আমাদের ফউজের সবচাইতে যোগ্য সালার।’ .
কিন্তু আপনি জানেন না, এ লোকটি আমীরুল মুমেনিনের নিকৃষ্টতম দুশমন, আর এঁর নাম যোবায়ের নয়, নয়ীম। ইনি দামেস্কের কয়েদখানা থেকে ফেরার হয়ে এখানে তাশরীফ এনেছেন।
‘এ কথা সত্যি?’ ওয়ালী পেরেশান হয়ে প্রশ্ন করলেন।
নয়ীম নীরব রইলেন।
ইবনে সাদেক বললো, আপনি এখখুনি গেরেফতার করে আমার অদিলিতে পেশ করুন।’
আমি বিনা সাক্ষ্য প্রমাণে একজন সালারকে গ্রেফতার করতে পারি না। প্রথম মোলাকাতেই আপনারা পরস্পরের সাথে এমন আচরণ করেছেন, যাতে মনে হচ্ছে যে, আপনাদের মধ্যে রয়েছে পুরানো বিদ্বেষ এবং এ অবস্থায় ইনি অপরাধী হলেও এর ভাগ্য নির্ধারণের ভার আমি আপনার উপর সোপার্দ করবো না।
‘আপনার জানা উচিত যে,আপনি স্পেনের মুফতিয়ে আযমের সাথে কথা বলছেন।’
‘আর আপনার জানা উচিত ছিলো যে, আমি স্পেনের শাসনকর্তা।’
“ঠিক, কিন্তু আপনি জানেন না যে, আমি স্পেনের মুফতিয়ে আযমের চাইতে বেশী আরো কিছু।
নয়ীম বললেন, ‘উনি জানেন না। আমি বলে দিচ্ছি। আপনি আমীরুল মুমেনিনের দোস্ত এবং কুতায়বা বিন মুসলিম, মুহাম্মদ বিন কাসিম ও ইবনে আমেরের হত্যাকারী, তুর্কিস্তানের বিদ্রোহের মূলে ছিলো আপনার অনুগ্রহ। আর আপনি সেই নির্মম নিষ্ঠুর লোকটি, যিনি আপন ভাই ও ভাতিজীকে কতল করতে দ্বিধা করেননি। এখন আপনি আমার কাছে অপরাধী। নয়ীম বিজলী চমকের মতো কোষ থেকে তলোয়ার বের করলেন এবং তার অগ্রভাগ ইবনে সাদেকের সিনার উপর রেখে বললেন, ‘আমি বহুত খুঁজেছি তোমায়, কিন্তু পাইনি। আজ কুদরৎ তোমায় এনেছেন এখানে। আমীরুল মুমেনিনের দোস্ত তুমি। তোমার পরিণাম তাঁর খুবই মর্মবেদনার কারণ হবে, কিন্তু আমার কাছে ইসলামের ভবিষ্যৎ খলিফার খুশীর চাইতে অধিকতর প্রিয়।
নয়ীম তলোয়ার উঁচু করলেন। ইবনে সাদেক কাঁপতে লাগলো বেতসের মতো। মৃত্যুকে মাথার উপর দেখে সে চোখ বন্ধ করলো। নয়ীম তার অবস্থা দেখে তলোয়ার নীচু করে কললেন, ‘না, তা হয় না। এ তলোয়ার দিয়ে আমি দিয়ে আমি সিন্ধু ও তুর্কিস্থানের ময়দানে কতো উদ্ধত শাহযাদার গর্দান উড়িয়ে দিয়েছি। তোমার মতো নীচু ভীরু বুদীলের খুনে আমি তলোয়ার রঞ্জিত করবো না কোষবদ্ধ করলেন। কামরায় ছেয়ে গেলো এক গভীর নিস্তব্ধতা।
এক ফউজী অফিসার এসে ভাঙলেন কামরার নিস্তব্ধতা। তিনি এসেই একটা চিঠি দিলেন আন্দলুসের ওয়ালীর হাতে। ওয়ালী চিঠিখানা বিস্ফারিত চোখে দুতিনবার পড়ে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি আপনার নাম যোবায়ের না হয়ে নয়ীম হয়ে থাকে, তাহলে আপনার জন্যও খবর আছে এ চিঠিতে।’ বলতে বলতে তিনি চিঠিখানা বাড়িয়ে দিলেন নয়ীমের দিকে। নয়ীম চিঠি নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। আমীরুল মুমেনিন উমর বিন আব্দুল আযীযের তরফ থেকে চিঠি।
আন্দালুসের ওয়ালী তালি বাজালেন। অমনি কয়েকজন সিপাহী এসে দেখা দিলো।
‘ওকে গ্রেফতার করো।’ ইবনে সাদেকের দিকে ইশারা করে তিনি বললেন।
ইবনে সাদেকের ধারণাই হয়নি যে, তার তকদীরের সিতারা উদয়ের সাথে সাথেই ঢেকে যাবে এমনি কালো মেঘে।
একদিকে নয়ীম দক্ষিণ পর্তুগালের দিকে চলে যাচ্ছেন শাসনকর্তার পদ গ্রহণের জন্য, অপর দিকে কয়েকজন সিপাহী ইবনে সাদেকের শিকলে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে দামেস্কের পথে। কয়েকদিন পর নয়ীম জানালেন যে, ইবনে সাদেক দামেস্ক পৌঁছবার আগেই পথে বিষ খেয়ে তার যিন্দেগী শেষ করে দিয়েছে।