যেয়াদের পা ক্রমে নিঃসাড় হয়ে এলো। যখমের রক্তধারা কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জমিনের উপর। তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে। দুহাতে সিনা চেপে সে গড়িয়ে পড়লো যমিনের উপর। ইবনে সাদেক এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো। সে যখন বুঝলো যে, যেয়াদ মরে গেছে অথবা বেহুশ হয়ে গেছে তখন সে এগিয়ে তার জেল থেকে চাবি নিয়ে দরযা খুলে বেরিয়ে গেলো।
বারমাক তখনো বাজার থেকে ফেরেনি। ইবনে সাদেক মুক্তি পেয়ে খানিকটা দৌড়ে ছুটে চললো। তারপর সে ভাবলো, শহরে কোনো বিপদ নেই তার। এবার সে নিশ্চিন্ত হয়ে চলতে লাগলো। শহরের লোকের কাছ থেকে বাইরের দুনিয়ার খবর নিয়ে সে এবার চললো রমলার পথে খলিফাঁকে তার কাহিনী শুনাতে।
ইবনে সাদেকের মুক্তির কয়েকদিন পর শোনা গেলো, খলিফা আব্দুল্লাহকে সরিয়ে দিয়েছেন সিপাহসালারের পদ থেকে এবং তাঁকে শংখলাবদ্ধ করে নেওয়া হচ্ছে রমলার দিকে। ইবনে সাদেক সম্পর্কে খবর রটলো যে, তাকে স্পেনে পাঠানো হয়েছে মুফতিয়ে আযমের পদে নিযুক্ত করে।
*
হিজরী ৯৯ সালে খলিফা সুলায়মান ফউজের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে কস্তানতুনিয়ার উপর হামলা চালালেন, কিন্তু পূর্ণ বিজয় লাভের আগেই তিনি বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে। উমর বিন আবদুল আযীয খিলাফতের তখতে আসীন হলেন। উমর বিন আবুদল আযীয স্বভাব ও চালচলনে ছিলেন বনু উমিয়ার তামাম খলিফা থেকে স্বতন্ত্র। তার খিলাফত আমল ছিলো বনু উম্মিয়া খিলাফতের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। মযলুম মানুষের প্রতি যুলুমের প্রতিকার হলো নয়া খলিফার প্রথম কর্তব্য। যেসব বড় বড় মুজাহিদ সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের রোষের শিকার হয়ে কয়েদ খানার অন্ধকার কুঠরীতে দিন যাপন করছিলেন, তাঁদেরকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হলো। অত্যাচারী বিচারকদের পদচ্যুত করে তাঁদের স্বলাভিষিক্ত করা হলো নেক দীল ও ন্যায়নিষ্ঠ হাকীমদের। রমলার কয়েদখানায় বন্দী আব্দুল্লাহকে মুক্তি দিয়ে ডেকে আনা হলো দরবারে খিলাফতে।
আব্দুল্লাহ দরবারে খিলাফতে হাযির হয়ে তার মুক্তির জন্য জানালেন শোকরিয়া। আমিরুল মুমেনিন প্রশ্ন করলেন, এখন কোথায় যাবে?
‘আমিরুল মুমেনিন! বহুদিন হয় আমি ঘরে ছেড়ে এসেছি। এখন আমি ঘরেই ফিরে যেতে চাই।’
‘তোমার সম্পর্কে আমি এক হুকুম জারী করেছি।’
‘আমি খুশীর সাথে আপনার হুকুম তামিল করবো। দ্বিতীয় উমর এক টুকরা কাগজ আব্দুল্লাহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমায় খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছি। তুমি একমাস ঘরে থেকে ফিরে এসে খোরাসানে পৌঁছে যাবে।’
আব্দুল্লাহ সালাম করে কয়েক কদম গিয়ে আবার থেমে দাঁড়িয়ে আমীরুল মুমেনিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘তুমি আরো কিছু বলবে?’ আমীরুল মুমেনিন প্রশ্ন করলেন।
‘আমীরুল মুমেনিন, আমি আমার ভাইয়ের সম্পর্কে আরয করতে চাচ্ছি। আমি তাঁকে দামেস্কের কয়েদখানা থেকে মুক্ত করবার চক্রান্ত করেছিলাম। তিনি বেকসুর। তাঁর একমাত্র কসুর, তিনি কুতায়বা বিন মুসলিম ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের ঘনিষ্ঠ দোস্ত ছিলেন এবং দরবারে খিলাফতে হাযির হয়ে তিনি আমীরুল মুমেনিনকে কুতায়বাকে হত্যার ইরাদা থেকে বিরত করবার চেষ্টা করেছিলেন।
দ্বিতীয় উমর প্রশ্ন করলেন, তুমি নয়ীম বিন আব্দুর রহমানের কথা বলছো?
জি হাঁ, আমিরুল মুমেনিন! তিনি আমার ছোট ভাই।’
‘এখন তিনি কোথায়?
‘স্পেনে। আমি তাঁকে আবু ওবায়দের কাছে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আগের খলিফা ইবনে সাদেককে ওখানকার মুফতিয়ে আযম নিযুক্ত করেছেন এবং সে নয়ীমের খুনের পিয়াসী।’
আমীরুল মুমেনিন বললেন, ইবনে সাদেক সম্পর্কে আজই আমি স্পেনের ওয়ালীকে লিখে হুকুম দিচ্ছি, তার পায়ে শিকল বেধে দামেস্কে পাঠাবেন। তোমার ভাইয়ের দিকেও আমার খেয়াল থাকবে।
‘আমীরুল মুমেনিন! নয়ীমের সাথে তার এক দোস্ত রয়েছে। তিনিও আপনার সদয় দৃষ্টি লাভের যোগ্য।’
আমীরুল মুমেনিন স্পেনের ওয়ালীর কাছে চিঠি লিখলেন এবং এক সিপাহীর হাতে দিয়ে বললেন, এবার তুমি খুশী হয়েছে? তোমার ভাইকে আমি দক্ষিণ পর্তুগালের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছি এবং তার দোস্তকে ফউজের উচ্চপদে নিযুক্ত করবার সুপারিশ করেছি। ইবনে সাদেক সম্পর্কেও আমি লিখে দিয়েছি।’
আব্দুল্লাহ আদব সহকারে সালাম করে বিদায় নিলেন।
*
আলুসের ওয়ালী থাকতেন কডোভায়। তিনি দক্ষিণ পর্তুগাল থেকে যোবায়ের নামক এক নয়া সিপাহসালারের বিজয়ের খবর শুনে অত্যন্ত খুশী। তিনি আবু ওবায়েদকে চিঠি লিখলেন এবং যোবায়েরের সাথে মোলাকাত করবার ইচ্ছা জানালেন। নয়ীম কর্ডোভায় পৌঁছে আলুসের ওয়ালীর খেদমতে হাযির হলেন। ওয়ালী তাকে সাদর অভ্যর্থনা করে গ্রহণ করলেন।
ওয়ালী বললেন, আপনার মোলাকাত পেয়ে আমি খুশী হয়েছি। আবু ওবায়েদ তার চিঠিতে আপনার যথেষ্ট তারিফ করেছেন। কয়েকদিন আগে আমি খবর পেয়েছি, উত্তর এলাকার পাহাড়ী লোকেরা বিদ্রোহ করছে। আমি তাদেরকে দমন করার জন্য আপনাকে পাঠাতে চাই। কাল পর্যন্ত আপনি তৈরী হবেন।
বিদ্রোহ হয়ে থাকলে তো আমার আজই যাওয়া দরকার। বিদ্রোহের আগুন ছড়ানোর সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।’
বহুত আচ্ছা। এখনি আমি সেনাবাহিনীর অধিনায়ককে ডাকাচ্ছি পরামর্শের জন্য।’