যেয়াদের কাছে তার যিন্দেগী আগের চাইতে আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে। আগে সে ছিলো নিছক গোলাম। কিন্তু এখন একটা মানুষের দেহ ও জানের উপর তার পুরো এখতিয়ার। সে যখন চায়, ইবনে সাদেককে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে। ইবনে সাদেক তার কাছে একটা খেলনার শামিল। এ খেলা নিয়ে খেলতে ক্লান্ত অনুভব করে না সে। তার নিরানন্দ জীবনে ইবনে সাদেক প্রথম ও শেষ আর্কষণ। তার প্রতি তার বিদ্বেষ, না প্রীতির আর্কষণ! যে, ভাবেই হোক, সে হরতোয তাকে চড়-চাপড় মারার, দাড়ি ধরে টানার ও মুখে থুথু দেবার না কোনো সুবিধা বের করে নেয়া বারমাক তার সামনে করতে দেয় না এসব, কিন্তু যখন সে খাবার সংগ্রহের জন্য বাজারে যায়, তখন যেয়াদ তার খুশীমতো কাজ করে।
আব্দুল্লাহর হুকুম মোতাবেক ইবনে সাদেককে দেওয়া হতো ভালো ভালো খানা। তার আরো হুকুম ছিলো যেনো সাদেককে কোনো তকলীফ দেওয়া না হয়। কিন্তু যেয়াদ অতো বেশী জরুরী মনে করতো না এ হুকুম। আরবী যবান কিছুটা জানা থাকলেও যেয়াদ ইবনে সাদেকের সাথে কথা বলতো তার মাতৃভাষায়। গোড়ার দিকে ইবনে সাদেকের অসুবিধা হতো, কিন্তু কয়েক মাস পরে সে বুঝতো যেয়াদের কথা।
একদিন বারমাক চলে গেলো বাজার থেকে খানাপিনার জিনিষপত্র আনতে। যেয়াদ বাড়ির এক কামরায় দাঁড়িয়ে খিড়কি ঋেকে উঁকি মেরে দেখলো, এক হাবশী গাধায় সওয়ার হয়ে বেরিয়ে আসছে শহর থেকে। দৈত্যাকৃতি হাবশীর বোঝা বয়ে জীর্ণ গাধার কোমর বেঁকে যাচ্ছে। গাধা চলতে চলতে শুয়ে পড়লো আর হাবশী শুরু করলো কোড়া বর্ষণ। গাধা নিরুপায় হয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাবশী আবার চাপলো তার পিঠে। খনিকটা পথ চলে গাধা আবার বসে পড়লো। হাবশী আবার মারতে লাগলো কোড়া। যেয়াদ অট্টহাস্য করে কামরা থেকে একটা কোড়া হাতে নিয়ে নামলো নীচে এবং ইবনে সাদেকের কয়েদখানার দর খুলে ঢুকলো ভিতরে।
ইবনের সাদেক যেয়াদকে দেখেই তৈরী হলো অভ্যাসমতো দাড়ি টানাতে ও কোড়ার ঘা খেতে, কিন্তু তার প্রত্যাশার বিরুদ্ধে যেয়াদ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। অবশেষে সে সামনে ঝুঁকে দুহাত যমিনের উপর ভর করে এক চার পেয়ে জানোয়ারর মতো হাত-পা দিয়ে দুতিন গজ চালবার পর ইবনে সাদেককে বললো, ‘এসো।
ইবনে সাদেক তার মতলব বুঝলো না। আজ কোনো নতুন খেলার ভয়ে সে ঘাবড়ে গেলো। ভয়ের আতিশয্যে তার পেশানীতে দেখা দিলো ঘাম।
যেয়াদ বললো, এসো, আমার উপর সওয়ার হও।’
ইবনে সাদেক জানতো, তার ভালো-মন্দ যে কোনো হুকুম মেনে চললেই তার ভালাই। তার হুকুম অমান্য করার শাস্তি হবে তার পক্ষে অসহনীয়। তাই ভয়ে ভয়ে সে সওয়ার হলো যেয়াদের পিঠে। যেয়াদ গোপন কক্ষের দেওয়ালের চারিদিকে দুতিন চক্কর লাগিয়ে ইবনে সাদেককে নীচে নামিয়ে দিলো। যেয়াদকে খুশী করতে গিয়ে সে খোশমুদীর স্বরে বললো, আপনি বেশ শক্তিমান।
কিন্তু যেয়াদ তার কথায় কান না দিয়ে উঠেই হাত ঝেড়ে ইবনে সাদেককে ধরে নীচে ঝুঁকিয়ে বললো, এবার আমার পালা।
ইবনে সাদেক জানতো, এ দৈত্যের বোঝা পিঠে নিয়ে সে পিষে যাবে, কিন্তু নিরুপায় হয়ে সে নিজেকে তকদীরের উপরে ছেড়ে দিলো।
যেয়াদ কোড়া হাতে ইবনে সাদেকের পিঠে সওয়ার হলো। ইবনে সাদেকের কোমর বেঁকে গেলো। এত ভারী বোঝা বয়ে চলা তার পক্ষে অসম্ভব। বহু কষ্টে দুতিন কদম চলে সে পড়ে গেলো। যেয়াদ তার উপর কোড়া বর্ষণ করতে শুরু করলো। কোড়ার ঘা খেয়ে ইবনে সাদেক বেহুশ হয়ে গেলো। যেয়াদ তাকে দেওয়ালে ভর করে বসিয়ে দিয়ে ছুটে গেলো বাইরে। খানিক্ষণ পর আবার কয়েদখানার দর খুলে সে ঢুকলো এক তশতরীতে কয়েকটা সেব ও আঙ্গুর নিয়ে। ইবনে সাদেক জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ খুললো। যেয়াদ আপন হাতে তার মুখে দিলো কয়েকটা আঙ্গুর। তারপর নিজের খনজর দিয়ে একটা সেব কেটে সে তার অর্ধেকটা দিলো ইবনে সাদেককে। ইবনে সাদেক তার হিসসা শেষ করলে যেয়াদ তাকে কেটে দিলো আর একটি সেব।
ইবনে সাদেক জানে, যেয়াদ কখনো কখনো তার প্রতি প্রয়োজনের চাইতে বেশী মেহেরবান হয়ে ওঠে। তাই সে দ্বিতীয় সেটি শেষ করে নিজেই যেয়াদকে তুলে দিলো তৃতীয় সেবটি। যেয়াদ তার খনজর রেখে দিয়েছে সেব গুলোর মাঝখানে। ইবনে সাদেক বেপরোয়া হয়ে সেটি হাতে তুলে নিয়ে সেবের খোসা ফেলতে শুরু করলো। যেয়াদ সবকিছুই দেখছে মনোযোগ দিয়ে। ইবনে সাদেক খজনর রেখে দিয়ে বললো, এগুলো খোসাশুদ্ধ খেলে ক্ষতি হয়।’
হুঁ।’ যেয়াদ মাথা নেড়ে আওয়ায করলো এবং একটি সেব তুলে নিজেও ইবনে সাদেকের মতো খোসা ফেলতে লাগলো। যেয়াদের হাত কেমন যেনো নিঃসাড় হয়ে আসছে। সে হাত মুখে দিয়ে ভাবতে লাগলোঃ
‘দিন, আমি খোসা তুলে দিচ্ছি।’ ইবনে সাদেক বললো।
যেয়াদ মাথা নেড়ে সেব ও খনজর দিলো তার হাতে। ইবনে সাদেক সেবের খোসা তুলে ফেলে তার হাতে দিয়ে প্রশ্ন করলো, আরো খাবেন আপনি? যেয়াদ মাথা নাড়লো এবং ইবনে সাদেক আর একটি সেব তুলে তার খোসা ফেলতে লাগলো।
ইবনে সাদেকের হাতে খুনজর। তার দীল ধড় ফড় করছে। সে চায়, একবার আবার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখবে, কিন্তু তার ভয়, হামলা করবার আগেই যেয়াদ তাকে ধরে ফেলবে বজ্রমুষ্ঠিতে। খানিকক্ষন চিন্তা করে সে দরযার দিকে ফিরে দেখে পেরেশান হবার ভান করে বললো, কে যেনো আসছে।’ যেয়াদও জলদী ফিরে তাকালো দরবার দিকে। ইবনে সাদেক অমনি অলক্ষ্যে তার সিনায় আমূল বিদ্ধ করে দিলো তার হাতের চকচকে খনজর এবং দ্রুত এক লাফে কয়েক কদম পিছলে গেলো। যেয়াদ রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দুহাত প্রসারিত করে এগিয়ে গেলো ইবনে সাদেকের গলা টিপে দিতে। ইবনে সাদেক তার সামনে অনেকখানি হালকা। দ্রুত গতিতে সে চলে গেলো তার নাগালের বাইরে গোপন কক্ষের এক কোণে। যেয়াদ সেদিকে এগুলো সে গেলো আর এক কোণে। যেয়াদ চারদিক দিয়ে তাকে ধরবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না।