নয়ীম সিপাহসালারের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কুতাবয়া বিন মুসলিম ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের ডান পাশে থেকে যতোটা আনন্দ লাভ করেছি, সিপাহীদের পিছনের কাতারে দাঁড়িয়েও আমি অনুরূপ আনন্দই পাবো।’
আপনার মতলব হচ্ছে যে আপনি….।
আবু ওবায়েদের কথা শেষ হবার আগেই ইউসুফ বলে উঠলেন, ইনি ছিলেন কুতায়বা ও ইবনে কাসিমের নামদা সালার। মাফ করবেন। আমি জানতাম না যে, আমি আমার চাইতে যোগ্যতর ও অধিকতর অভিজ্ঞ সালারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আবু ওয়ায়েদ আর একবার নয়ীমের সাথে মোসাফেহা করলেন।
‘এবার আমি বুঝেছি, কেন আমীরুল মুমেনিনের বিষ নযরে আপনি পড়েছেন। এখানে কোন বিপদ নেই আপনার। তবু সতর্কতার খাতিরে আজ থেকে আপনার নাম যোবায়ের ও আপনার দোস্তের নাম হবে আবদুল আযীয। আপনার সাথে কেউ আছেন?
নয়ীম বললেন, ‘জি হাঁ, আমার বিবিও সাথে আছেন। তাকে আমি রেখে এসেছি এক সরাইখানায়।’
‘ওহো, তার জন্যও আমি একটা বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। আবু ওবায়েদ আওয়ায দিয়ে এক নওকরকে ডেকে হুকুম দিলেন শহরে একটা ভালো বাড়ি খুঁজে দিতে।
*
চারমাস পর একদিন নয়ীম বর্মপরিহিত হয়ে নার্গিসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, যে রাত্রে ভাই আব্দুল্লাহ ও উমরার শাদী হলো, সেই রাত্রেই তিনি রওয়ানা হয়ে গেলেন জিহাদের ময়দানে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, উযরার মুখে চিন্তা ও দুঃখের মামুলী রেখাঁটিও নেই।’
‘আপনার মতলব আমি বুঝেছি।’ নার্গিস হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আপনি কতোবার বলেছেন, তাতারী মেয়েরা আরব মেয়েদের মোকাবিলায় বহুত কমোের, কিন্তু আমি আপনার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেবো।’
নয়ীম বললেন, পর্তুগাল বিজয়ে আমার প্রায় ছয় মাস লেগে যাবে। আমি চেষ্টা করবো। এরই মধ্যে একবার এসে তোমায় দেখে যেতে। আমি না আসতে পারলেও ঘাবড়ে যেয়ো না। আবু ওবায়েদ আজ এক পরিচারিকাকে পাঠাবেন তোমার কাছে।
‘আমি আপনাকে….। নার্গিস দৃষ্টি অবনত করে বললেন, ‘একটা নতুন খবর শোনাতে চাই।’
‘শোনাও।’ নয়ীম নার্গিসের চিবুক স্নেহে উপরে তুলে বললেন।
‘আপনি যখন ফিরে আসবেন।’.
হাঁ হাঁ, বলো।’
‘আপনি জানেন না?’ নার্গিস নয়ীমের হাত ধরে মৃদু চাপ দিতে দিতে বললেন।
আমি জানি। তোমার মতলব, শিগগিরই আমি বাচ্চার বাপ হতে চলেছি। এই তো?’ এর জওয়াবে নার্গিস তার মস্তক নয়ীমের সিনার সাথে লাগালেন।
নার্গিস, আমি তার নাম বলে যাবো? ….তার নাম হবে আব্দুল্লাহ। আমার ভাইয়ের নাম।
‘আর যদি মেয়ে হয়ে, তবে?
না, ছেলেই হবে। আমার চাই এমন বেটা, যে তীরবৃষ্টি ও তলোয়ারের ঝংকারের ভিতরে খেলে বেড়াবে। আমি তাকে তীরন্দাযী, নেহাবাযি, শাহসওয়ারীর শিক্ষা দেবো। পূর্বপুরুষের তলোয়ার দীপ্তি অব্যাহত রাখবার জন্য পয়দা করতে হবে তার বায়ুতে তাকৎ দীলে হিম্মৎ।
*
ওফাতের কিছুকাল আগে খলিফ ওয়ালিদ কস্তানতুনিয়া বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেছিলেন জঙ্গী জাহারের এক বহর এবং এক ফউজ পাঠিয়েছিলেন এশিয়া মাইনরের পথে, কিন্তু সে হামলায় মুসলমানরা কঠিন ব্যর্থতার মোকাবিলা করলো। কস্তানতুনিয়ার মজবুত পাঁচিল জয় করবার আগেই মুসলমানদের রসদ গেলো ফুরিয়ে। আর এক মুসীবৎ হলো এই যে, শীতের মওসুম শুরু হতেই লশকরের ভিতর মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে হাজারো মুসলমানের প্রাণ বিনষ্ট হলো। এসব মুসীবতের ভিতর দিয়ে এক বছর অবরোধের পর মুসলিম সেবাহিনীকে ফিরে আসতে হলো।
মুহাম্মদ বিন কাসিম ও কুতায়বা বিন মুসলিম বাহেলীর মর্মান্তিক পরিণতির পর সিন্ধু ও তুর্কিস্তানে ইসলামী বিজয় অভিযানের গতি প্রায় শেষ হয়ে এলো। সুলায়মান এ অখ্যাতির কলংক অপসারণের জন্য চাইলেন কস্তানতুনিয়া জয় করতে। তার ধারণা ছিলো যে, কস্তানতুনিয়া জয় করতে পারলে তিনি বিজয় গৌরবে খলিফা ওয়ালিদকে ছাড়িয়ে যাবেন, কিন্তু দুর্ভগ্যবশত এ বিজয় অভিযানের জন্য তিনি বাছাই করলেন এমন সব লোক, সিপাহীর যিন্দেগীর সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর সিপাহসালার যখন পায়ে পায়ে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে লাগলেন তখন তিনি আন্দালুসের ওয়ালীকে হুকুম দিলেন একজন বাহাদুর ও অভিজ্ঞ সালারকে পাঠিয়ে দিতে। সেই হুকুম অনুযায়ী আব্দুল্লাহ হাযির হয়ে দামেস্ক থেকে পাঁচ হাজার সিপাহী নিয়ে রওয়ানা হলেন কাস্তানতুনিয়ার পথে। যাতে কস্তানতুনিয়ার উপর হামলাকারী ফউজের দেখাশুনা করা যায়, তারই জন্য সুলায়মান নিজেও দামেস্ক ছেড়ে রমলায় বানালেন তার দারুল খিলাফত। কয়েকবার তিনি হামলাকারী ফউজ পরিচালন করলেন, কিন্তু কোনো সাফল্যই লাভ হলো না। সুলায়মানের বেশীর ভাগ নির্দেশের সাথে আব্দুল্লাহ একমত হতেন না। তিনি চাইতেন যে, তুর্কিস্তান ও সিন্ধুর যেসব মশহুর সালার কুতায়বা বিন মুসলিম ও মুহম্মদ বিন কাসিমের অনুরক্ত বলে পদচ্যুত হয়েছেন, তাদেরকে আবার ফউজের শামিল করে নেওয়া হোক। কিন্ত খলিফা তাদের বদলে ভর্তি করে দিলেন তার কতিপয় অযোগ্য দোস্তকে।
সুলায়মানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে ঘৃণার মনোভাব পয়দা হলো। নিজের কমযোরী কম্পর্কে তিনিও ছিলেন সচেতন। কেবল খলিফার তুষ্টির জন্য খোদার রাহে জান-মাল উৎসাৰ্গকারী সিপাহীরা রক্তপাত পছন্দ করতো না। তাই ইসলামের পথে আত্মোৎসর্গের সে পুরানো মনোভাব ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে এলো। ইবনে সাদেক গায়েব হয়ে যাওয়ায় খলিফার পেরেশানি গেলো বেড়ে। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আসন্ন মুসীবৎ সম্পর্কে তাকে বেপরোয়া করে তুলবার মতো আর কেউ নেই তখন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মতো বেগুনাহ মানুষকে হত্যা করার ফলে তার বিবেক তাকে কষাঘাত করতে লাগলো। ইবনে সাদেককে খুঁজে বের করবার সব রকম প্রচেষ্টা করা হলো। গুপ্তচররা ছুটে বেড়াতে লাগলো, পুরস্কার ঘোষনা করা হলো, কিন্তু কোথাও মিললো না কোনো সন্ধান।
চৌদ্দ
আব্দুল্লাহ জানতেন যে, খলিফা ইবনে সাদেকের সন্ধানের জন্য সর্বপ্রকার সম্ভাব্য চেষ্টাই করবেন। তাই তাকে যিন্দাহ রাখা বিপজ্জনক, কিন্তু তিনি তার মতো নীচু মানুষের রক্তে হাত কলংকিত করা বাহাদুর সিপাহীর পক্ষে শোভন মনে করেন নি। কস্তানতুনিয়ার পথে তার ফউজ যখন কৌনিয়া নামক স্থানে এসে থামলো, তখন আব্দুল্লাহ শহরের শাসনকর্তার সাথে দেখা করে তার দামী জিনিসপত্র হেফাযত করবার জন্য একটি বাড়ি পাবার ইচ্ছা জানালেন। শহরের শাসনকর্তা আব্দুল্লাহকে দিলেন একটি পুরানো জনহীন বাড়ি। আব্দুল্লাহ ইবনে সাদেককে বন্ধ করে রাখলেন সেই বাড়ির গোপন কক্ষে। বারমাক ও যেয়াদের উপর হেফাযতের দায়িত্ব অর্পন করে ফউজ নিয়ে তিনি চলেন কস্তানতুনিয়ার পথে।