নয়ীম কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে ভাইয়ের সাথে আলীংগনাবদ্ধ হলেন। আব্দুল্লাহ বললেন, “আর দেরী করো না ভোর হলো বলে। কায়রোয়ান পৌঁছবার আগে কোথাও দম নেবে না। বারমাক আমার সাথে যাবে।
নয়ীম ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনে। আব্দুল্লাহ তার হাতে চুমু খেলেন এবং চোখে স্পর্শ করলেন।
‘ভাই, উযরা কেমন আছে?’ নয়ীম বিষণ্ণ আওয়াযে প্রশ্ন করলেন।
‘সে ভালোই আছে। আল্লার মনযুর হলে আমরা স্পেনে তোমাদের সাথে মিলবো আবার।’
আব্দুল্লাহ এরপর ইউসুফের সাথে মোসাফেহা করলেন এবং নার্গিসের কাছে গিযে হাত বাড়ালেন। নার্গিস তার মতলব বুঝে মাথা নীচু করলেন। আব্দুল্লাহ সস্নেহে তার মস্তকে হাত বুলিয়ে দিলেন।
নার্গিস বললেন, ভাইজান, উযরাকে আমার সালাম বলবেন।
আচ্ছা খোদা হাফিয।’ আব্দুল্লাহ বললেন।
তিনজন সমস্বরে তার জওয়াবে ‘খোদা হাফি’ বলে ঘোড়র বাগ ঢিলা করে দিলেন। আব্দুল্লাহ ও বারমাক খানিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। নয়ীম আর তার সারা রাতের অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেলে তারা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে গেলেন সেনাবাসে।
পাহারাদারেরা আব্দুল্লাহকে চিনতে পেরে সালাম করলো। আব্দুল্লাহ বারমাকের ঘোড়া এক সিপাহীর হাতে সঁপে দিয়ে তার সওয়ারীর জন্য উটের ইনতেযাম করে আবার ফিরে গেলেন শহরের দিকে।
*
যেয়াদ তার মালিকের হুকুম পেয়েছে ইবনে সাদেকের দিকে পুরোপুরি খেয়াল রাখবার। সে এতটা খেয়াল রেখেছে ইবনে সাদেকের দিকে যে, তার মুখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়নি আর কোনোদিক। ঘুম পেলে সে উঠে সেই খুঁটির চারদিকে ঘুরতে থাকে। এ নিঃসঙ্গতা তার আর ভালো লাগে না। আচানক এক খেয়াল এলো তার মাথায়। সে ইবনে সাদেকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাকে ভালো করে দেখতে লাগলো। তার মুখে আচানক এক ভয়ংকর হাসি দেখা দিলো। সে ইবনে সাদেকের চিবুকের নীচে হাত দিয়ে তার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে থুথু দিতে লাগলো তার মুখে। তারপর সে পূর্ণ শক্তি দিয়ে কয়েকটা কোড়া মারলো ইবনে সাদেকের পিঠে এবং এমন জোরে তার মুখে মারলো এক চড় যে সে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার হুশ ফিরে এলে যেয়াদ তার দাঁড়ি ধরে টানতে লাগলো। ইবনে সাদেক যখন অসহায়ভাবে গর্দান ঢিলা করে দিলো, তখন যেয়াদও তাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরতে থাকলো তার আশপাশে।
ইবনে সাদেকের হুঁশ হলে যখন সে চোখ খুললো, যেয়াদ তখন আবার তেমনি উত্তম মাধ্যম লাগালো। কয়েকবার এমনি করে যখন সে বুঝলে যে তার আর কোড়া খাবার মতো তাকৎ নেই, তখন সে বিড়বিড় করে খুঁটির আশপাশে ঘুরেলো এবং মাঝে মাঝে ইবনে সাদেকের দাড়ি ধরে এক আধটা টান মারলো। কখনো কখনো সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে, আবার খানিকক্ষণ পর খানিকটা তামাশা করে।
ভোরের আযানের সময়ে যেয়াদ দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, আব্দুল্লাহ ও বারমাক আসছেন.। সে শেষবার থুথু দিতে, কোড়া ও চড় মারতে এবং দাড়ি ধরে টানতে চাইলো। তখনো ইবনে সাদেকের দাড়ি ধরে ঝাঁকুনি দেওয়া শেষ হয়নি। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ ও বারমাক এসে পৌঁছলেন।
আব্দুল্লাহ বললেন, বেসকুফ, কি করছো তুমি? ওকে জলদী সিন্দুকে ঢুকাও। যেয়াদ তখখুনি তার হুকুম তামিল করে আধামরা আজদাহকে ঢুকালো সিন্দুকের মধ্যে।
য়ের পরক্ষণেই আব্দুল্লাহ ফউজ নিয়ে চললেন কস্তানতুনিয়ার পথে। রসদ বোঝাই উটগুলোর মধ্যে একটির পিঠে চাপানো হয়েছে একটি সিন্দুক। যেয়াদের উটটি তার পাশে। লশকরের মধ্যে আব্দুল্লাহ, বারমাক ও যেয়াদ ছাড়া আর কেউ জানে না, সিন্দুকের মধ্যে কি রয়েছে।
আব্দুল্লাহর হুকুমে বারমাকও ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চললো। সিন্দুকয়াওলা উটের পাশে পাশে।
*
নয়ীম নার্গিস ও ইউসুফকে সাথে নিয়ে কায়রোয়ান পৌঁছলেন। সেখান থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তারা গেলেন কডোভায়। কর্ডোভা থেকে ধরলেন তেতালার পথ। সেখানে পৌঁছে নার্গিসকে এক সরাইখানায় রেখে তিনি ইউসুফকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আবু ওবায়েদের খেদমতে হাযির হয়ে পেশ করলেন আব্দুল্লাহর চিঠি।
আবু ওবায়েদ চিঠি পড়ে ইউসুফ ও নয়ীমের দিকে ভালো করে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন, আপনারা আব্দুল্লাহর দোস্ত। আজ থেকে আমাকেও আপনার দোস্ত মনে করবেন। আব্দুল্লাহ নিজের ফিরে আসবেন না?
নয়ীম জওয়াব দিলেন, আমীরুল মুমেনিন তাকে পাঠিয়েছেন কস্তানতুনিয়া অভিযানে।
‘কস্তানতুনিয়ার চাইতে এখানেই তার প্রয়োজন ছিলো বেশী। তারিক ও মুসার স্থান নেবার মতো আর কেউ নেই। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি এবং পূর্ন উদ্যম সহকারে কর্তব্য পালন করতে পারছি না। আপনারা জানেন, শাম ও আরব থেকে এদেশ অনেক খানি আলাদা। এখনাকার পাহড়ী লোকদের যুদ্ধের তরিকাও আমাদের থেকে স্বতন্ত্র। পরে এখানে আপনাদেরকে ফউজের কোনো উঁচু পদ দেওয়া যাবে। আপাততঃ মামুলী সিপাহী হিসাবে অভিজ্ঞতা হাসিল করতে হবে বেশ কিছুদিন। তারপর আপনাদের হেফাযতের সওয়াল। সে সম্পর্কে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। যদি আমীরুল মুমেনিন এখান পর্যন্ত আপনাদের তালাশ করেন, তাহলে আপনাদেরকে পৌঁছে দেওয়া যাবে কোনো নিরাপদ জায়গায়। কিন্তু আমার নীতি হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির যোগ্যতার পরীক্ষা না নিয়ে আমি তার উপর কোনো জিম্মাদারী দেই না।’