সাঈদ আর যহীর ছেলেবেলা থেকে পরস্পরের দোস্ত তাঁদের। দোস্তি তাঁদেরকে সহোদর ভাইয়ের চাইতেও কাছে টেনে এনেছে। দু’জন লেখা পড়া করেছেন একই জায়গায়। একই জায়গায় তাঁরা যুদ্ধবিদ্যা শিখেছেন, আর কতো ময়দানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিখিয়েছেন বায়ুর শক্তি ও তলোয়ারের তেয! সাঈদ যহীরকে হঠাৎ আসার কারণ শুধালেন।
কায়রুনের ওয়ালী আমায় আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। সাঈদ বললেন।
সব খবর ভালো তো!’
না। সাঈদ জওয়াব দিলেন, আফ্রিকায় দ্রুতগতিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে। রুমের লোকেরা জাহেল বার্বার দলকে উত্তেজিত করে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই বিদ্রোহের আগুন নিভিয়ে দিবার জন্য গড়ে তুলতে হবে নতুন ফউজ। গভর্নর দরবারে খিলাফতে সাহায্যের আবেদন করে বিফল হয়েছেন। নাসারা শক্তি আমাদের কমর্যেরীর সুযোগ নিচ্ছে। অবস্থা আয়ত্বে আনতে না পারলে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবো এ বিশাল ভূখন্ড। গভর্নর তাই আমায় আপনার কাছে পাঠিয়েছেন এই চিঠি নিয়ে।
যহীর চিঠি খুলে পড়লেন। চিঠির মর্ম হচ্ছে : সাঈদ তোমায় আফ্রিকার অবস্থা খুলে বলবে। মুসলমান হিসাবে তোমার ফরযঃ যতো সিপাহী সংগ্রহ করতে পার, তাদেরকে নিয়ে শীগগিরই এখানে পৌঁছবে। খলিফার দরবারেও আমি এক চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আরবের লোকেরা যেমন নানারকম গৃহবিবাদে লিপ্ত রয়েছে, তাতে ওখান থেকে আমার কোনো সাহায্য পাবার উম্মীদ নেই। নিজের তরফ থেকে তুমি চেষ্টা করো।’
যহীর এক নওকরকে ডেকে সাঈদের ঘোড়াটি তার হাওয়ালা করে দিলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে গেলেন ঘরের একটি কামরায়। তাঁর চোখ থেকে প্রিয়া মিলনের রাত্রির নেশা ততোক্ষণে কেটে গেছে। অপর কামরায় গিয়ে দেখলেন, ইয়াসমিন আল্লাহর দরগায় সিজদায় পড়ে রয়েছে। তার দীল আনন্দে ভরে উঠলো। ফিরে। সাঈদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন সাঈদ আমার শাদী হয়ে গেছে।
মুবারক হোক। কবে?
কাল।’
মুবারক হোক। সাঈদের মুখে হাসি, কিন্তু মুহূর্তে সে হাসি কোথায় উবে গেলো। পুরানো বন্ধুর চোখের উপর তিনি চোখ রাখলেন। তাঁর দৃষ্টি যেনো সুধাচ্ছে, এই যে শাদীর আনন্দ তা তোমায় জিহাদের উৎসাহ থেকে ফিরিয়ে আনবে না তো? যহীরের চোখ জওয়াবে প্রকাশ করছিলো সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়।
*
দুনিয়ার কম বেশি করে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে অবশ্যি আসে এমন সব মুহূর্ত, যখন সে উচ্চস্তরে পৌঁছবার অথবা মহৎ কার্য করবার সুযোগ পায়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাভ-লোকসানের হিসাব করে আমরা হারিয়ে ফেলি সে মওকা।
সাঈদ প্রশ্ন করলেন, “চিঠি সম্পর্কে আপনি কি চিন্তা করলেন? যহীর হাসতে হাসতে সাঈদের কাঁধে হাত রেখে বললেনঃ এতে আমার চিন্তার কি আছে? চলো।’
‘চলো-কথাটা বাইরে খুবই সহজ। কিন্তু যহীরের মুখে কথাটি শুনে সাঈদের মনে যে খুশী হলো, তা আন্দাজ করা কঠিন। নিজের অলক্ষ্যে তিনি বন্ধুর সাথে আলিংগনাবন্ধ হলেন। যহীরের মুখে আর কোনো কথা নেই। তিনি সাঈদকে সাথে নিয়ে ঘরের বাইরে মসজিদের দিকে চললেন।
ফজরের নামাযের পর যহীর বক্তৃতা করতে উঠলেন। মুজাহিদের কথার প্রভাব বিস্তার করতে না লাগে সুন্দর সুন্দর শব্দ সংযোজন আর না লাগে লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি। তাঁর সাদাসিধা আবেগপূর্ণ কথা গুলো লোকের দীলের মধ্যে বসে গেলো। বক্তৃতার মধ্যে তিনি উঁচ গলায় বললেনঃ
মুসলমান ভাইগণ! আমাদের স্বার্থ সন্ধান ও গৃহবিবাদ আমাদেরকে কখনো রক্ষা করতে পারবে না। রুম ও ইউনানের যে সালতানাতকে আমরা বহুবার পদলুণ্ঠিত করেছি, আজ এই মুহূর্তে তারা আর একবার আমাদের মোকাবিলা করবার সাহস করছে। তারা ইয়ারমুক ও আজনাদিনের পরাজয় ভুলে গেছে। এসো, আমরা তাদেরকে আর একবার জানিয়ে দেই যে, ইসলামের মর্যাদা হেফাজত করবার জন্য মুসলমান অতীতের মতো আজো তার বুকের খুন তেমনি অকাতরে বিসর্জন দিতে পারে। তারা নানা রকম ষড়যন্ত্র করে আফ্রিকার বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। তাদের ধারণা, গৃহবিবাদের ফলে আমরা কমযোর হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি বলতে চাই, যতোক্ষণ একটিমাত্র মুসলমান যিন্দাহ খাকবে, তততক্ষণ আমাদের দিকে ভীতির দৃষ্টিতে তাকাতে হবে তাদেরকে।
মুসলমানগণ! এসো, আবার আমরা তাদেরকে বলে দেই, হযরত উমরের (রাঃ) যামানায় যেমন ছিলো, আজো আমাদের সিনায় রয়েছে সেই একই উদ্যম, বায়ুতে রয়েছে সেই তাকৎ আর তলোয়ারে রয়েছে সেই তে।’
যহীরের বক্তৃতার পর আড়াইশ নওজোয়ান তাঁর সাথী হবার জন্য তৈরী হলো।
*
ইয়াসমিনের যিন্দেগীর সকল আকাংখার কেন্দ্রস্থল স্বামী তার চোখের সামনে থেকে বিদায় নিয়ে চলেছেন ময়দানে জংগের দিকে। তার দীলের আগুন চোখের পথ ধরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আঁসুর ধারায়, কিন্তু স্বামীর সামনে নিজকে বুদীল প্রমাণিত করতে বাধা দিচ্ছে তার আত্মসমবোধ। চোখের আঁসু চোখেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
যহীর তাকালেন তাঁর বিবির মুখের দিকে। দুঃখ ও বিষণ্ণতার মূর্ত রূপ দাঁড়িয়ে আছে তার চোখের সামনে। তাঁর দীল বলছে আরো এক লহমা দেরী করতে, আরো কয়েকটি কথা বলতে, কিন্তু সেই দীলেরই আর একটি দাবী-আর একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে তাকে।
আচ্ছা ইয়াসমিন, খোদা হাফিয। বলে যহীর লম্বা লম্বা কদম ফেলে দরবার দিকে গেলেন এবং দরযা খুলে বাইরে যাবার উপক্রম করলেন। কি যেনো ভেবে তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন আপনা থেকেই। যে ধারণা তিনি কখনো মনের কাছেও আসতে দেননি, তা যেনো বিদ্যুৎগতিতে তার দীল ও মস্তিস্ক আচ্ছন্ন করে ফেললো। দীলের সূক্ষ্ম অনুভূতি তার কমফের আওয়াযে শুধু জানিয়ে দিলো, হয়তো এই-ই তাদের শেষ মোলাকাত। মুহূর্তের মধ্যে এই ধারণা যেনো এক বিপর্যয় সৃষ্টি করে দিলো। যহীরের পা আর এগুতে চাইলো না। ইয়াসমিন কয়েক কদম এগিয়ে এলো। যহীর চোখ বন্ধ করে দু’বাহু প্রসারিত করে দিলেন। ইয়াসমিন কান্না ভারাতুর চোখে আত্মসমর্পণ করলো তার আলীংগনের মধ্যে।