আব্দুল্লাহ্ গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় ইউসুফের কথা শুনলেন। তার দীলের মধ্যে পয়দা হচ্ছে নানারকম ধারণা। তিনি ইউসুফকে প্রশ্ন করলেন, তাঁর আকৃতি আমার সাথে মেলে তো’?
‘কিন্তু তিনি তোমার চাইতে কিছুটা লম্বা।’
‘তাঁর নাম নয়ীম তো নয়’? আব্দুল্লাহ্ বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন।
‘হ নয়ীম। তুমি চেনো তাকে?
তিনি আমার ভাই আমার ছোট ভাই।
‘ওহ, আমি তো তা জানতাম না!
আব্দুল্লাহ্ মুহূর্তকাল নীরব থেকে বললেন, যদি তার নাম হয়ে থাকে নয়ীম, তার পেশানী আমার পেশানীর চাইতে চওড়া, তার নাক আমার নাকের চাইতে কিছুটা পাতলা, চোখ আমার চোখের চাইতে বড়, ঠোঁট আমার ঠোঁটের চাইতে পাতলা ও খুবসুরত, উচচতা আমার চাইতে একটু বেশী আর দেহ আমার দেহের চাইতে খানিকটা পাতলা হয়ে থাকে, তাহলে আমি কসম খেতে পারি যে, লোকটি, আমার ভাই ছাড়া আর কেউ নন। তিনি কততদিন বন্দি রয়েছেন?
‘প্রায় দু’মাস হলো তিনি কয়েদ হয়েছেন। আব্দুল্লাহ, এখন ওকে বাঁচাবার পরামর্শ করতে হবে আমাদেরকে।
নিজের জান বিপদের মুখে ঠেলে না দিয়ে তুমি তার জন্য কিছু করতে পারো না।’ আব্দুল্লাহ বললেন।
‘আব্দুল্লাহ, তোমার মনে পড়ে, কডোভা অবরোধ কালে আমি যখমী হয়ে মরতে চলেছিলাম, তখন তুমি নিজের জীবন বিপন্ন করে অ তীর বৃষ্টির মাঝখানে লাশের তূপের ভিতর দিয়ে এনেছিলে আমায়’?
‘সে ছিলো আমার ফরয। তোমার উপকার আমি করিনি।’
‘আমিও একে মনে করছি আমার ফরয। একে তোমার উপকার আমি মনে করছি না।’ আব্দুল্লাহ খানিকক্ষণ ইউসুফের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ইতিমধ্যে ইউসুফের হাবশী গোলাম যেয়াদ এসে খবর দিলো, ইবনে সাদেক তার সাথে দেখা করবার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইউসুফের মুখ পার হয়ে গেলো। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে আব্দুল্লাহকে বললেন, তুমি আর এক কামরায় চলে যাও। ও যেনো সন্দেহ না করে।’
আব্দুল্লাহ জলদী পিছনের কামরায় চলে গেলেন। ইউসুফ কামরার দরযা বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর যেয়াদকে বললেন, ওকে ভিতরে নিয়ে এসো।
যেয়াদ চলে যাবার পরেই ইবনে সাদেক ভিতরে এলো। ইনে সাদেক কোন রকম সৌজন্য না দেখিয়ে এসেই সরাসরি বললো, আপনি আমায় দেখে খুবই হয়রান হয়েছেন, না?
ইউসুফ মুখের উপর অর্থপূর্ণ হাসি টেনে এনে বললো, এখানে কেন, যে কোন জায়গায় আপনাকে দেখে আমি হয়রান হই, আপনি তশরীফ রাখুন।’ ইবনে সাদেক কামরার চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করে পিছনের কামরার দরযার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো, আজ আমি খুবই ব্যস্ত। আচ্ছা, আপনার সে দোস্ত কোথায়?
ইউসুফ পেরেশান হয়ে বললেন, ‘কোন্ দোস্ত?
‘কোন দোস্তের কথা জিজ্ঞেস করছি, আপনি জানেন।’
আপনার মতো এলমে গায়েব তো আমার নেই।’
‘আমার মতলব নয়ীমের ভাই আব্দুল্লাহ কোথায়?
“আপনি কি করে জানেন যে, আব্দুল্লাহ নয়ীমের ভাই?
নয়ীমের সব খবর জানতে আমি কয়েক বছর কাটিয়ে দিয়েছি। ওর সাথে আমার কতোখানি জানাজানি, তা আপনি জানেন?
ইউসুফ তীব্রকণ্ঠে জওয়াব দিলেন, তা আমি জানি, কিন্তু আব্দুল্লার কাছে আপনার কি কাজ আমি জানতে পারি কি?’
ইবনে সাদেক বললো, তাও আপনি জানতে পারেন। আগে বলুন সে কোথায়?
‘আমি কি জানি? কারুর সাথে আপনার জানাজানি থাকলে আমি যে তার গোপন খবর নিয়ে বেড়াবো, এ তো জরুরী নয়।
ইবনে সাদেক বললো, দরবারে খিলাফত থেকে যখন সে বেরিয়ে এলো, তখন আপনি তার সাথে ছিলেন। যখন সে সেনাবাসে গেলো, তখন আপনি তার সাথে। যখন সে ফিরে শহরে এলো, তখনো আপনি তার সাথে। ভেবেছিলাম, এখনো সে আপনাদেরই সাথে রয়েছে।’
‘এখানে খানা খেয়ে তিনি চলে গেলেন।
কখন?’
‘এখখুনি।
‘কোন দিকে?
হয়তো সেনাবাসের দিকে।’
এও তো হতে পারে যে, কয়েদখানা দিকে গেছে অথবা ভাইয়ের বিধবাকে সান্ত্বনা দিতে গেছে।
কভাইয়ের বিধবা? আপনার মতলব….?
ইবনে সাদেক দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়ে জওয়াব দিলো, আমার মতলব, কাল পর্যন্ত সে বিধবা হয়ে যাবে। আমি আপনাকে আমীরুল মুমেনিনের হুকুম শুনাতে এসেছি যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের তামাম দোস্তকে ভালো করে দেখা শুনা করবেন। তাদের সম্পর্কে কালই হুকুম জারী করা হবে। আর নিজের তরফ থেকে আমি আপনার খেদমতে আরয করছি, আপনি নিজের জানকে প্রিয় মনে করলে আব্দুল্লাহর সাথে মিলে নয়ীমের মুক্তির ষড়যন্ত করবেন না।’
‘আমি এরূপ ষড়যন্ত্র করতে পারি, তা আপনি কি করে বললেন? ইউসুফ ক্ৰদ্ধ স্বরে বললেন।
আমি তা বিশ্বাস করি না, কিন্তু হয়তো আল্লাহর দোস্তির জন্য আপনি বাধ্য হতে পারেন। আচ্ছা, আপনি কয়েদখানার পাহারায় কতো সিপাহী রেখেছেন?
ইউসুফ জওয়াব দিলেন, ‘চল্লিশজন আর আমি নিজেও যাচ্ছি ওখানে।’
‘সম্ভব হলে আরো কিছু সিপাহী রাখুন, কেননা শেষ মুহূর্তে সে ফেরার হয়ে যেতে পারে।
‘এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন আপনি? এতো একটি সাধারণ লোক। পাঁচ হাজার লোক কয়েদখানার উপর হামলা করেও তাকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে না।
‘আমার স্বভাবই আমায় আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেনত করে দেয়। আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। আরো কিছু সিপাহী আমি পাঠিয়ে দেবো। আপনি তাদেরকে নয়ীমের কুঠরীর পাহারায় লাগিয়ে দিন।
ইউসুফ আশ্বাসের স্বরে বললেন, আপনি আশ্বস্ত থাকুন। নতুন পাহারাদারের প্রয়োজন নেই। আমি নিজে পাহারা দেবো। আপনি এত উদ্বিগ্ন কেন?’