সে রাগ করে বললো, তুমি জান আমি কে?
আমি ঘাবড়ে গেলাম। সালেহ কিছু বলবে না বলে সে আমায় আশ্বাস দিলো। আমি বাধ্য হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কুঠরীর দিকে ইশারা করলাম। ইবনে সাদেক এগিয়ে গিয়ে দর দিয়ে উঁকি মারতে লাগলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। তিনি তার দিকে লক্ষ্য করলেন না। অবজ্ঞার স্বরে ইবনে সাদেক বললো, হাজ্জাজের দুলাল, তোমার অবস্থা কি?
মুহাম্মদ বিন কাসিম চমকে উঠে তাকালেন তার দিকে, কিন্তু মুখে কোনো কথা বললেন না।
‘আমায় চিনতে পারো? ইবনে সাদেক প্রশ্ন করলো।
মুহাম্মদ বিন কাসিম বললেন, আপনি কে, আমার মনে পড়ছে না।
সে বললো, “দেখলে, তুমি আমায় ভুলে গেছে, কিন্তু আমি তোমায় ভুলিনি।’
মুহাম্মদ বিন কাসিম এগিয়ে এসে দরযার লৌহ-শলাকা ধরে ইবনে সাদেকের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বললেন, আপনাকে হয়তো কোথাও দেখেছি, কিন্তু মনে পড়ছে না।
ইবনে সাদেক কোনো কথা না বলে তাঁর হাতের উপর নিজের ছড়ি দিয়ে আঘাত করলো এবং তার মুখের উপর থুথু ফেললো।
কি আশ্চর্য! মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুখে বিন্দুমাত্র বিরক্তির চিহ্ন দেখা গেলো না। তিনি তাঁর কামিজের প্রান্ত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, বুড়ো! তোমার বয়সের কোনো লোককে কখনো আমি তকলীফ দেইনি। না জেনে যদি আমি তোমায় কোনো দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে আর একবার থুথু দিতে আমি তোমার খুশী মনে অনুমতি দিচ্ছে।—-’আমি সত্যি বলছি তখন মুহাম্মদ বিন কামিমের সামনে পাথর থাকলেও তা গলে যেতো। আমার মন চাইছিলো, ইবনে সাদেকের দাড়ি উপড়ে ফেলি, কিন্তু দরবারে খিলাফতের ভয় অথবা আমার বুজদীলি আমায় কিছুই করতে দিলো না। তারপর ইবনে সাদেক তাঁকে গাল দিতে দিতে চলে গেলো। মধ্যরাত্রের কাছাকাছি সময়ে আমি কয়েদখানায় ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, মুহাম্মদ বিন কাসিম দুই জানুর উপর বসে হাত তুলে দো’আ করছেন। আমি আর তাকাতে পারলাম না। তালা খুলে আমি ভিতরে গেলাম। দো’আ শেষ করে তিনি আমার দিকে তাকালেন।
‘উঠুন। আমি তাকে বললাম।
‘কেন?’ তিনি হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলেন।
আমি বললাম, এ গুনাহ করবার কাজে আমি হিংসা দিতে চাই না। আমি আপনার জান বাঁচাতে চাই।’
তিনি বসতে বসতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার হাত ধরলেন। আমায় কাছে বসিয়ে তিনি বললেন, একে তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমীরুল মুমেনিন, আমায় কতল করবার হুকুম দেবেন। আর যদি তা হয়, তাহলেও কি আমি জান বাঁচাতে তোমায় বিপদের মুখে ঠেলে দেবো’?
আমি বললাম, আমার জানের উপর কোনো বিপদ আসবে না। আমিও আপনার সাথে চলে যাবো। আমার দুটি অত্যন্ত দ্রুতগামী গোড়া রয়েছে। আমরা শিগীরই চলে যাবো বুহুদূরে। আমরা গিয়ে কুফা ও বসরার লোকদের কাছে আশ্রয় নেবো। তারা আপনার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত। ইসলামী দুনিয়ার সব বড় বড় শহর আপনার আওয়াজে সাড়া দেবে।’
তিনি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ধারণা আমি বিদ্রোহের, আগুন জেলে দিয়ে মুসলমানদের ধ্বংসের দৃশ্য দেখতে থাকবো? না, তা হতে পারে না। এ হবে কাপুরুষতা। বাহাদুর লোকদের বাহাদুরের মত্য কামনা করাই উচিত। আমি নিজের জান বাঁচাতে গিয়ে হাজারো মুসলমানের জান বিপদের মুখে ঠেলে। দেবো না। তুমি কি চাও, দুনিয়া মুহাম্মদ বিন কাসিমকে মুজাহিদ হিসাবে স্মরণ না। করে বিদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করুক’?
আমি বললাম, কিন্তু মুসলামানদের তো আপনার মতো বাহাদুর সিপাহীর প্রয়োজন রয়েছে।’
তিনি বললেন, মুসলমানদের মধ্যে তোমাদের মতো সিপাহীর অভাব হবে না। ইসলামকে যারা কমবেশী করে বুঝেছে, তাদের ভিতরে শ্রেষ্ঠ সিপাহীর গুণরাজি পয়দা করে তোলা কিছু কঠিন নয়।’
আমার মুখে কথা যোগালো না। আমি উঠতে উঠতে বললাম, মাফ করবেন। আপনি আমার কল্পনার চাইতেও বহু উর্ধ্বে।’ তিনি উঠে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন, দরবারে খিলাফত হচ্ছে মুসলমানদের শক্তিকেন্দ্র। তার সাথে বিশ্বাস ভংগের খেয়াল কখনো মনে এনো না।’
ইউসুফের কথা শেষ হলো। আব্দুল্লাহ্ তার ব্যথাতুর দৃষ্টি লক্ষ্য করে বললেন, তিনি ছিলেন এক সত্যিকার মুজাহিদ।
ইউসুফ বললেন, এখন আর একটি ব্যাপার আমার কাছে মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। আমি এখুনি তোমায় বলেছিলাম কুতায়বা বিন্ মুসলিম বাহেলীর এক সালারের কথা। তার আকৃতি ও দেহাবয়ব তোমার সাথে অনেকখানি মেলে। উচ্চতায় সে তোমার চাইতে কিছুটা লম্বা। তাঁর সাথে আমার অনেকটা ভাব জন্মেছে। খোদা
করেন, যদি তারও পরিণতি একই হয়, তাহলে আমি বিদ্রোহ করবো। সে বেচারার একমাত্র কসুর, তিনি কয়েকটি ভালো কথা বলেছিলেন মুহাম্মদ বিন্ কাসিম ও কুতায়বা সম্পর্কে। এখন ইবনে সাদেক হয়রায় কয়েদখানায় গিয়ে তাকে দুঃখ দেয়া। আমি বুঝি যে, ইবনে সাদেকের কথায় তার মনে অশেষ বেদনা লাগে। আমার কাছে কতোবার তিনি প্রশ্ন করেছেন, কবে তাকে আযাদ করা হবে। আমার ভয় হয়, ইবনে সাদেকের কথামতো খলিফা তাকে ছেড়ে দেবার পরিবর্তে কতল করে না ফেলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের আরো কয়েকজন দোস্ত রয়েছেন কয়েদখানায় বন্দী। তাঁদের সাতে যে ব্যবহার করা হয়, তা খুবই লজ্জাজনক। সেই নওজোয়ান সালারের তাতারী বিবিও এসেছেন তার সাথে। তিনি তার এক আত্মীয়ের সাথে থাকেন শহরে। কয়েকদিন আগে তিনি আমায় তার বিবির খবর দিয়েছন। তার নাম সম্ভবতঃ নার্গিস। তার বাড়ির কাছেই আমার খালার বাড়ি। তার সাথে আমার খালার খুব ভাব জমেছে। তিনি সারা দিনই ওখানে থাকেন এবং আমায় অনুরোধ করেন তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবার চেষ্টা করতে। আমি কি করবো আর কি করে তার জান বাঁচাবো, কিছুই ভেবে পাই না।