ইবনে কাসিম সম্পর্কে তোমার কি ধারণা’?
আমীরুল মুমেনিন, তিনি এক বাহাদুর সিপাহী, এর বেশী আমি কিছু জানি না।’
এদের প্রতি আমি কতোটা বিদ্বেষপরায়ণ, তা তুমি জানো?’ সুলায়মান বললেন।
‘আমীরুল মুমেনিন, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমি মুনাফেক নই। আপনি আমার ব্যক্তিগত মত জানতে চেয়েছেন। তা আমি প্রকাশ করেছি।’
আমি তোমার কথার কদর করছি। তুমি কখনো আমার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে অংশ নেওনি, তাই আমি তোমায় বিশ্বাস করি।
‘আমিরুল মুমেনিন, আমার বিশ্বাসের যোগ্যই পাবেন।
‘বহুত আচ্ছা! কাস্তাতুনিয়া অভিযানের জন্য একজন অভিজ্ঞ সালারের প্রয়োজন আমাদের ওখানে আমাদের ফউজ কোনো কামিয়াবি হাসিল করতে পারেনি। সেই জন্যই তোমায় ডেকে আনা হয়েছে স্পেন থেকে। তুমি খুব জলদী এখান থেকে পাঁচ হাজার সিপাহী নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাও কাস্তানতুনিয়ার পথে।’
সুলমায়ন এক নকশা নিয়ে আব্দুল্লাহকে কাছে ডেকে তাঁর সামনে খুলে ধরে লম্বা-চওড়া আলোচনা শুরু করে দিলেন।
দারোয়ান এসে এক চিঠি পেশ করলো।
সুলায়মান জলদী করে চিঠিটা পড়ে ইবনে সাদেকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, কুতায়বা কতল হয়ে গেছে। কয়েকদিন মধ্যে তার মস্তক এসে পৌঁছবে এখানে।
‘মোবারক হোক।’ ইবনে সাদেক খলিফার হাত থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে পড়তে বললো ‘ওই নওজোয়ান সম্পর্কে আপনি কি ভেবেছেন?
কুতায়বার তরফ থেকে কিছুদিন আগে যে এখানে এসেছিলো। খুব বিপজ্জনক লোক বলে মনে হয় ওকে।’
হ্যাঁ, তাঁর সম্পর্কেও আমি শীগগীরই ফয়সলা করবো।
খলিফা আবার আবদুল্লাহর দিকে মনোযোগ দিলেন।
‘তোমার পরামর্শ আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। তুমি জলদী রওয়ানা হয়ে যাও।
‘আমি কালই রওয়ানা হয়ে যাচ্ছি।’ বলে আবদুল্লাহ সালাম করে বেড়িয়ে পড়লেন। আব্দুল্লাহ্ দরবারে খিলাফত থেকে বেরিয়ে বেশী দূর যান নি। পেছন থেকে একটি লোক তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে দাঁড় করালেন। আবদুল্লাহ্ পেছনে ফিরে দেখলেন, এক সুদর্শন নওজোয়ান তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আবদুল্লাহ তাঁকে বুকে চেপে ধরলেন।
ইউসুফ, তুমি এখানে কি করে এলে? তুমি স্পেন থেকে এমনি কুরে গায়েব হয়ে গেলে যে, আর তোমার চেহারা দেখা গেল না কোনদিন।
‘এখানে আমায় কোতায়ালের চাকুরী দেওয়া হয়েছে। তোমায় দেখে খুব খুশী হয়েছি। আবদুল্লাহ্ তুমিই প্রথম ব্যক্তি, যার স্পষ্ট কথায় খলিফা রেগে যান নি।
‘কেন না আমাকে তার প্রয়োজন।’ আব্দুল্লাহ্ হাসিমুখে জওয়াব দিলেন, ‘তুমি ওখানেই ছিলে?
আমি এক দিকে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি লক্ষ করোনি।’ ভোরেই তুমি চলে যাচ্ছো?
তুমিতো শুনেছো।’
আজ রাত্রে আমার কাছে থাকবে না’?
‘তোমার কাছে থাকতে পারলে আমি খুশী হতাম, কিন্তু ভোরেই লশকরকে এগিয়ে যাবার হুকুম দিতে হবে। তাই আমার সেনাবাসে থাকাই ভালো হবে।’
‘আবদুল্লাহ্, চলো। তোমার ফউজকে তৈরী থাকার হুকুম দিয়ে আসবে। আমিও তোমার সাথে যাচ্ছি। খানিক্ষণ পরেই আমরা ফিরে আসবো। এতদিন পর দেখা। অনেক কথা বলা যাবে।’
আচ্ছা চলো।’
আব্দুল্লাহ ও ইউসুফ কথা বলতে বলতে সেনাবাসে প্রবেশ করলেন। আব্দুল্লাহ আমীরে লশকরের কাছে খলিফার হুকুমনামা দিয়ে ভোরে পাঁচ হাজার সিপাহী তৈরী রাখবার নিদের্শ দিলেন। তারপর তিনি ইউসুফের সাথে ফিরে চলে এলেন শহরের দিকে।
রাতের বেলায় ইউসুফের গৃহে খানা খেয়ে আব্দুল্লাহ ও ইউসুফ কথাবার্তায় মশগুল হলেন। তারা কুতায়বা বিন বাহেলীর বিজয় অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করে মর্মান্তিক পরিণামে আফসোস প্রকাশ করলেন।
আব্দুল্লাহ প্রশ্ন করলেন, কুতায়বার কতলের খবরে আমীরুল মুমেনিনকে মোবারকবাদ জানালো যে লোকটি, সে কে?
ইউসুফ জওয়াব দিলেন, “এ লোকটি তামাম দামেস্কের কাছে এক রহস্য। ওর নাম ইবনে সাদেক, এবং খলিফা ওয়ালিদ ওর মস্তকের মূল্য এক হাজার আশরাফী নির্ধারণ করেছিলেন, ওর সম্পর্কে এর বেশী আর কিছু জানা নেই আমার। খলিফার ওফাতের পর সে কোনো গোপন আবাস থেকে বেরিয়ে এসেছে সুলায়মানের কাছে। নয়া খলিফা ওকে যথেষ্ট খাতির করেন এবং বর্তমান অবস্থায় খলিফা ওর চাইতে বেশী আমল দেন না আর কারুর কথায়। আব্দুল্লাহ্ বললেন, ‘বহুদিন আগে আমি কিছু শুনেছিলাম ওর সম্পর্কে দরবারে খিলাফতে ওর আধিপত্য মুসলমানদের জন্য বিপদের কারণ হবে। বর্তমান অবস্থায় বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের সামনে এক দুঃসময় আসন্ন।
ইউসুফ বললেন, আমি ওর চাইতে কঠিন-হৃদয় নীচ প্রকৃতির লোক এ যাবত দেখিনি। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মর্মান্তিক পরিণতিতে চোখের পানি না ফেলেছে, এমন লোক দেখিনি। সুলায়মান কঠিন-হৃদয় হয়েও কয়েকদিন কারুর সাথে কথা বলেন নি, কিন্তু এই লোকটিই সেদিন ছিলো যার পর নাই খুশী। আমার হাতে ক্ষমতা এলে আমি ওকে কুকুর দিয়ে খাওয়াতাম। এই লোকটি কারুর দিকে আঙ্গুলের ইশারা করলে আমীরুল মুমেনিন তাকে জল্লাদের হাতে সোর্পদ করে দেন। কুতায়বাকে কতল করবার পরামর্শ এই লোকটিই দিয়েছে এবং আজ তুমি শুনেছো সে খলিফাঁকে আর একজন কয়েদীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।’..
হ্যাঁ, সে লোকটি কে’?
তিনি হচ্ছেন কুতায়বার এক জোয়ান সালার। তার কথা মনে পড়লে আমার দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের চাইতে তাঁর পরিণতি আরো মর্মান্তিক হবে বলে আমার ধারণা। আবদুল্লাহ্ আমার মন চায়, এ কাজ ছেড়ে দিয়ে আবার আমি গিয়ে ফউজে শামিল হই। আমার বিবেক আমায় দংশন করছে অনবরত। মুহাম্মদ বিন কাসিকে নিয়ে আরবের তামাম বাচ্চা-বুড়ো গর্ব করেছে, কিন্তু fি অপরাধীর প্রতিও যে আচরণ করা হয় না, তাই করা হয়েছে তার সাথে। তাঁকে যখন ওয়াসতের কয়েদখানায় পাঠানো হলো, তখন তাঁর দেখাশুনা করবার জন্য আমায় হুকুম দেওয়া হলো সেখানে যেতে। আগে থেকেই ওয়াসতের হাকীম সালেহ ছিলো তাঁর রক্তপিয়াসী। সে মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর চালালো কঠিন নির্যাতন। কয়েকদিন পর ইবনে সাদেকও পৌঁছলো সেখানে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের দীলে ব্যথা দেবার নিত্যনতুন তরিকা সে উদ্ভাবন করতো। সেই মুহূর্তটি আমি ভুলতে পারি না, কতল হবার একদিন আগে যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম কয়েদখানার কুঠরীর ভিতরে পায়চারী করছিলেন আমি লৌহ কপাটের বাইরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর প্রতিটি কার্যকলাপ। তাঁর খুবসুরত মুখের ভাবগাম্ভীর্য দেখে আমার মন চাইতো ভিতরে গিয়ে পায়ে চুমু খেতে। রাতের বেলায় কঠিন পাহারার হুকুম ছিলো আমার উপর। আমি তাঁর অন্ধকার কুঠরীতে মোমবাতি জ্বেলে দিলাম। এশার নামাযের পর তিনি ধীরে ধীরে পায়চারী করতে লাগলেন। এক প্রহার রাত কেটে গেলে এই ঘৃণিত কুকুর ইবনে সাদেক কয়েদখানার ফটকে এসে চীৎকার শুরু করলো। পাহারাদার দর্য খুলে দিলে সাদেক আমার কাছে এসে বললো, আমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে দেখা করবো। আমি জওয়াব দিলাম সালেহ হুকুম দিয়েছেন তার সাথে কারুর মোলকাতের এযাত দেওয়া হবে না।