মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভয়াবহ পরিণামের পর মুসার আহত দীলের উপর নুনের ছিটা দেওয়া হলো। এরপর সুলায়মান কুতায়বাকে জালে ফেলবার চক্রান্ত শুরু করলো। কুতায়বার ব্যক্তিত্ব তামাম ইসলামী সাম্রাজ্যের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। আরবী ও ইরানী ফউজ ছাড়া তুর্কিস্তানের নও মুসলিমরাও তাঁকে ভক্তি করতো মনে প্রাণে। সুলায়মানের মনে আশংকা জাগলো, বিদ্রোহ করে বলে তিনি হয়ে উঠবেন। তাঁর শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর কার্যকলাপের ফলে যারা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে, তারা সবাই হবে বিদ্রোহের সমর্থক। এই মুশকিল থেকে বাঁচাবার কোনো পন্থা তাঁর মাথায় এলো না। তাই তিনি ইবনে সাদেকের কাছে চাইলেন পরামর্শ। ইবনে সাদেক বললো, হুজুর! ওঁকে দরবারে হাযির হবার হুকুম পাঠিয়ে দিন। যদি আসে তো ভালো, নইলে আর কোন তরিকা অবলম্বন করা যাবে।’
‘কেমন তরিকা?’ সুলায়মান প্রশ্ন করলেন।
‘হুজুর! সে কর্তব্য এ বান্দার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন, ওঁকে তুর্কিস্তানেই কতল করা যাবে।
*
নার্গিসের সাহচর্যে নয়ীমের কয়েক হফতা কেটে গেলো এক সোনালী স্বপ্নের মতো। উপত্যকা ও পাহাড়ের প্রতিটি প্রাকৃতিক দৃশ্য তাঁর মনে জাগায় এক স্বপ্নময় ভাবালুতা। তারই বর্ণচ্ছটায় বিভোর হয়ে নয়ীম ঘরে ফিরে যাবার ইরাদা কিছুদিনের জন্য মুলতবী রাখলেন, কিন্তু তার দীলের এ ভাবাবেগ বেশি দিন থাকলো না। একদিন তিনি ঘুম থেকে জেগে নার্গিসকে বললেন, আমি এতগুলো দিন এখানে কি করে কাটিয়ে দিয়েছি, তা নিজেই ভাবতে পারি না। এখন আমার শিগগীরই চলে যাওয়া দরকার। আমাদের বস্তি এখান থেকে বহু মাইল দুরে। সেখানে গিয়ে তোমার মন কেমন করবে না তো?
মন কেমন করবে? হায়! আমার দীলে আপনার দেশ দেখবার কি যে আগ্রহ, আর সে পবিত্র ধুলি চোখে লাগবার জন্য আমি কতোটা বেকারার, তা যদি আপনি জানতেন! আচ্ছা, পরশু আমরা এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবো। বলে নয়ীম ফজরের নামায পড়বার জন্য তৈরী হতে লাগলেন। ইতিমধ্যে হুমান ভিতরে প্রবেশ করলো। সে নয়ীমকে বললো যে, বস্তির বারমাক নামে এক সিপাহী কুতায়বা বিন্ মুসলিমের পয়গাম নিয়ে এসেছে।’ নয়ীম পেরেশান হয়ে বাইরে গেলেন। বারমাক ঘোড়ার বাগ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে ভালো খবর নিয়ে আসেনি বলে নয়ীমের মনে, জাগলো সন্দেহ। নয়ীমের প্রশ্নে অপেক্ষ না করেই বারমাক বললো, আমার সাথে যাবার জন্য আপনি এখখুনি তৈরী হয়ে নিন।’
‘খবর ভাল তো? নয়ীম প্রশ্ন করলেন।’
বারমাক কুতায়বার চিঠি পেশ করলো। নয়ীম চিঠি খুলে পড়লেন। তাতে লেখা রয়েছে, তোমায় বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে যে চিঠি পাওয়ামাত্র সমরকন্দে পৌঁছে যাবে। আমীরুল মুমেনিনের মৃত্যুতে যে অবস্থার উদ্ভব হয়েছে, তারই জন্য তোমায় এ হুকুম দেওয়া হচ্ছে। বিস্তারিত বিবরণ বারমাকের কাছে শুনতে পাবে।’
নয়ীম হয়রান হয়ে বারমাকের কাছে প্রশ্ন করলেন, সমরকন্দ থেকে বিদ্রোহের খবর আসেনি তো?
না।’ বারমাক জওয়াব দিলো।
তা হলে আমায় সমরকন্দে যাবার হুকুম কেন দেওয়া হলো?
কুতায়বা তার তামাম সালারকে নিয়ে কি যেনো পরামর্শ করবেন।
‘কিন্তু তিনি তো কাশগড়ে ছিলেন।
না, নানা করণে তিনি সমরকন্দ চলে গেছেন।
কি ধরনের কারণ?
বারমাক বললো, আমিরুল মুমেনিনের ওফাতের পর পরবর্তী খলিফা সুলায়মান হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিযুক্ত বহু অফিসারকে কতল করে ফেলেছেন। মুসা বিন্ নুছায়েরের পুত্রকেও সিন্ধু-বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সালারকেও হুকুম দেওয়া হয়েছে দরবারে খিলাফতে হাযির হতে। তিনি সেখানে যেতে বিপদের আশংকা করছেন, কেন না খলিফার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা নেই। তাই তিনি তাঁর সালারদের জমা করে পরামর্শ করতে চাচ্ছেন। তাই আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তিনি আমায় পাঠিয়েছেন।’
নয়ীম বারমাকের কথার শেষের দিকটা মন দিয়ে শুনতে পারেন নি। মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের কতলের খবর শোনার পর আর কোনও কথার উপর তিনি গুরুত্ব দেননি মোটেই।
অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে তিনি বললেন, বারমাক! তুমি বড়োই দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছো। বসো, আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
নয়ীম ফিরে গিয়ে নামাযে দাঁড়ালেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখ দেখে নার্গিসের মনে হাজারো দুর্ভাবনা জেগে উঠেছে। নামায শেষ হোলে নার্গিস সাহস করে তাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি খুবই পেরেশান হয়েছেন, দেখছি। কেমন খবর নিয়ে এলো লোকটি?
‘নার্গিস, আমরা এখনি সমরকন্দ চলে যাচ্ছি। তুমি জলদী তৈরী হয়ে নাও।
নয়ীমের জওয়াবে নার্গিসের বিষণ্ণ মুখ খুশীতে দীপ্ত হয়ে উঠলো। নয়ীমের সাথে থেকে যিন্দেগীর সব রকম বিপদের মোকাবিলা করবার সাহস মওজুদ রয়েছে তাঁর দীলের মধ্যে, কিন্তু যে কোনো মুসীবতে তাঁর কাছ থেকে জুদা হওয়া তাঁর কাছে মৃত্যুর, চাইতেও বেশি ভয়ংকর। নয়ীমের সাথে তিনি যাচ্ছেন, এই তাঁর কাছে যথেষ্ট। কোথায় আর কি অবস্থার ভিতরে, সে সব প্রশ্নে জওয়াব পাবার চেষ্টা তার কাছে অবান্তর।
*
সমরকন্দের কেল্লার এক কামরায় কুতায়বা তার বিশ্বস্ত সালারদের মাঝখানে বসে তাঁদের সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন। কামরার চারদিকে প্রাচীরের সাথে ঝুলানো বিভিন্ন দেশের বড় বড় নকশা। কুতায়বা চীনের নকশার দিকে ইশারা করে বললেন, আমরা আর কয়েকমাসের মধ্যে এই বিস্তীর্ণ ভূ-খন্ড জয় করে ফেলতাম, কিন্তু নয়া খলিফা আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন বড়ো দুঃসময়ে। তোমারা জানো, ওখানে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে?