না, না, তোমার শাহযাদার কসম, তিনি এসে গেছেন। এসেই তিনি তোমার কথা জানতে চেয়েছেন। আমি সব কিছু বলেছি তাঁকে। তার সাথে এসেছেন এক বৃদ্ধ। তিনি চুপি চুপি তোমার ভাইকে কি যেনো বললেন, আর তোমার ভাই আমায় পাঠালো তোমার খোঁজে। হুমানকে আজ খুব খুশী দেখাচ্ছে। চলো নার্গিস!
নার্গিস যমরুদের সাথে পাহাড় থেকে নীচে নামলো। যমদ খুব দ্রুত গতিতে চলছে, কিন্তু নার্গিসের পা দুটি কাঁপছে। সে বললো, যমররুদ! একটু ধীরে চলো।
অত তাড়াতাড়ি চলতে পারছি না আমি।
গাঁয়ের বহুলোক এসে জমা হয়েছে হুমানের ঘরে। ওয়াকি নয়ীম ও নার্গিসের নিকাহ পড়ালেন। দুলহা-দুলহিনের উপর চারদিক থেকে হলো পুষ্পবৃষ্টি।
যমররুদ এক কোণে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে মানের দিকে। হুমানের মুখ খুশির দীপ্তিতে উজ্জ্বল। এক বৃদ্ধ তাতারী কানের কাছে সে কি যেনো বললো। আর বৃদ্ধ তাতারী যমররুদের বাপের কাছে গিয়ে বললো কয়েকটি কথা। যমররুদের বাপ সম্মতি জানালে সে হুমানকে ধরে নিয়ে গেলো খিমার বাইরে।
‘আজই?’ যমররুদের বাপ বললেন।
যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
বহুত আচ্ছা! আমি ঘরে গিয়ে পরামর্শ করে আছি।’ যমরুদের বাপ ঘরে চলে গেলেন।
সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগে সব লোক যমরুদের ঘরে এসে জমা হলো। হুমান ও যমরুরুদের নিকাহ্ পড়াবার ভারও পড়লো ওয়াকির উপর।
দুলহিনকে হুমানের ঘরে আনা হলে যখন নার্গিস ও যমররুদ নির্জন আলাপের সুযোগ পেলো, তখন নার্গিস একটি ছোট্ট চামড়ার বাস খুললো।
যমররুদ! তোমার শাদীর দিনে আমি তোমায় একটি উপহার দিতে চাচ্ছি।’ বলে সে নয়ীমের দেওয়া রুমালখানি বের করে তার হাতে দিয়ে বললো, এই মূহুর্তে এর চাইতে দামী আর কিছু নেই আমার কাছে।
যমররুদ বললো, তোমার শাহযাদা না এলে এতটা মহৎ প্রাণের পরিচয় দিতে না তুমি।
নার্গিস যমররুদকে বুকে চেপে ধরে বললো, যমররুদ! এখনো আমার খোশনসীবের কল্পনা করতে ভয় পাই আমি। আজকের সবগুলো ঘটনা যেন একটা স্বপ্ন।’
যমদ হেসে বললো, যদি সত্যি সত্যি এটা একটা স্বপ্ন হয়? তাহলে আমি সে মন-ভোলান স্বপ্ন ভংগের পর বেঁচে থাকতে চাইবো না।’নার্গিস জওয়াব দিলো।
ওয়াকি আর তার সাথীরা সেখানেই রাত কাটালেন। ফজরের নামাযের পর তাঁরা তৈরী হলেন সফরের জন্য। বিদায় বেলায় নয়ীম বললেন, তিনিও শিগগীরই পৌঁছবেন বসরায়।
হমানের ঘরের যে কামরায় কিছুকাল আগে নয়ীম অপরিচিত মেহমান ছিলেন, আজ নার্গিস ও তার থাকার জায়গা হলো সেই কামরায়। নয়ীমের কাছে এ বস্তি আজ জান্নাতের প্রতিরূপ। দুনিয়ার সব কিছুই তার কাছে আজ আগের চাইতে বেশী মুগ্ধকর। ফুলের ঘ্রাণ, হাওয়ার মর্মরধ্বনি, পাখীদের কলগুঞ্জন-সব কিছুই প্রেম মিলনের এক সুর-মুছনায় বিভোর।
বারো
খলিফা ওয়ালিদের হুকুমাতের শেষভাগে ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে কাশগড় ও সিন্ধু পর্যন্ত মুসলমানদের বিজয় ঝান্ডা উড্ডীন হয়েছিলো। ইসলামী ইতিহাসের তিনজন সিপাহসালার পৌঁছে গিয়েছিলেন খ্যাতি ও যশের সর্বোচ্চ শিখরে। পূর্বদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু নদের কিনারে ডেরা ফেলে হিন্দুস্তানের বিস্তীর্ণ ভুখন্ড জয়ের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
কুতায়বা কাশগড়ের এক উঁচু পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে ইনতের করছিলেন দরবারে খিলাফত থেকে চীন সাম্রাজ্যের দিকে এগিয়ে যাবার হুকুমের জন্য।
পশ্চিমে মুসার লশকর চেষ্টা করছিলো ফিরে নিজের পাহাড়শ্রেণী অতিক্রম করে ফ্রান্সের সীমানায় প্রবেশ করবার, কিন্তু হিজরী ৯৪ সালে খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যু ও তাঁর স্থলে খলিফা সুলায়মানের অভিষেকের খবর ইসলামী বিজয়-অভিযানের নকশা বদলে দিলো। বহুদিন ধরে সুলায়মানের দীলের মধ্যে জ্বলছিলো খলিফা ওয়ালিদ ও তাঁর সহকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের আগুন। খলিফার মসনদে বসেই তিনি ডেকে পাঠালেন ওয়ালিদের প্রিয় সিপাহসালারদের। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্য তিনি কঠিনতম শাস্তি নির্ধারিত করে রাখলেন, কিন্তু যিন্দেগীর দুঃখময় দিন আসবার আগেই তিনি দুনিয়া ছেড়ে গেলেন। হাজ্জাজের মৃত্যুতেও সুলায়মানের সিনা ঠান্ডা হলো না। চাচার উপর তার প্রতিহিংসার ফল ভাতিজার উপর ফললো। মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু থেকে ডেকে এনে কঠিন পীড়ণের পর হত্যা করা হলো। মুসার খেদমতের বদলায় তাঁর সর্বস্ব রাজেয়াফত করা হলো এবং তাঁর নওজোয়ান পুত্রের মস্তক ছেদন করে তার সামনে পেশ করা হলো। এই নৃশংস যুলুমে ইবনে সাদেক ছিলো সুলায়মানের ডান হাত। এই বৃদ্ধ শৃগাল ঝড়-ঝঞ্জার হাজারো আঘাত খেয়েও হিম্মৎ হারায়নি। খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যু তার কাছে ছিলো এক আনন্দের বার্তা। হাজ্জাজ আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর প্রিয়জনদের কাউকে কয়েদ করা হলো, আর কাউকে পাঠানো হলো মৃত্যুর দেশে। দুনিয়ার ইবনে সাদেকের আর কোনো আশংকা রইলো না। সে তার নির্জন আবাস থেকে বেরিয়ে এসে হাজির হলো সুলায়মানের দরবারে। সুলায়মান তার পুরানো দোস্তকে চিনতে পেরে তাকে যথেষ্ট সমাদর করলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ইবনে সাদেক হলো খলিফার প্রধান মন্ত্রণাদাতাদের অন্যতম।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সম্পর্কে খলিফার অন্যান্য মন্ত্রণাদাতা যখন মত দিলেন যে, তিনি নিরপরাধ এবং নিরপরাধকে হত্যা করা জায়েয নয়, তখন ইবনে সাদেক এমনি খাঁটি লোকের বেঁচে থাকা তার নিজের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করলো। সে মুহাম্মদ বিন কাসিমের হত্যা শুধু জায়েয নয়, জরুরী প্রমাণ করবার জন্য বললো, ‘আমীরুল মুমেনিনের দুশমনের যিন্দাহ্ থাকবার কোনো অধিকার নেই। এ লোক হাজ্জাজের ভাতিজা। সুযোগ পেলেই এ ধরনের লোক বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেবে।