‘একি সম্ভব যে, সে আমার চাইতে বেশি সুন্দরী কোনো নারীকে দেখেছে? ভাবতে ভাবতে কুরসী থেকে উঠে সে প্রাচীরের গায়ে লাগানো একটা বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ দেখে নিলো এবং কামবার মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। মারওয়ারিদ একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে লাগলো তার কার্যকলাপ।
আপনি আজ ঘুমোবেন না,’ মারওয়ারিদ প্রশ্ন করলো।
যতক্ষণ সে আমার পায়ে এসে না পড়বে, ততক্ষণ ঘুম নেই আমার।
বলে হুসনেআরা আরও খানিকটা দ্রুত পায়ে ঘুরতে লাগলো এদিক ওদিক। মারওয়ারিদ উঠে কামরার খিড়কী দিয়ে তাকিয়ে রইলো পাইন বাগিচার দিকে। আচানক তার নযরে পড়লো, একটি লোক বাগিচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতের ইশারায় হুসনেআরাকে কাছে ডেকে সে বাগিচার দিকে ইশারা করে বললো দেখুন! বিলকুল আপনারই মত বেকারার হয়ে কে যেন পায়চারী করছে বাগিচায়।’
হুসনেআরা বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। লোকটি গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এলে চাঁদের পূর্ণরৌশনী যখন তাঁর মুখের উপর পড়লো, তখন হুসনেআরা নয়ীমকে চিনে ফেললো। হুসনেআরা বিষন্দু মুখে খেলে গেলো একটা হাসির রেখা।
মারওয়ারিদ আমি এখখুনি আসছি’ বলে হুসনেআরা কামরার বাইরে চলে গেলো এবং দেখতে দেখতে বাগিচায় গিয়ে নয়ীমকে দেখতে লাগলো এক গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। নয়ীম তখন ঘুরতে ঘুরতে সেই গাছের কাছে এলেন, অমনি হুসনেআরা এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালো গাছের আড়াল থেকে। নয়ীমও চমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হয়রান হয়ে তাকাতে লাগলেন তার দিকে।
‘আপনি ঘাবড়ে গেলেন? আমি দুঃখিত।
তুমি কি করে এখানে এলে?
‘আমি আপনার কাছে তাই জানতে চাচ্ছি।’ হুসনেআরা আরো এক কদম এগিয়ে এসে বললো।
‘আমার তবিয়ৎ ভালো ছিলো না।’
‘খুব! তাহলে আপনারও তবিয়ৎ বিগয়ে যায়! আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বুঝি আমাদের মতো মানুষ থেকে আলাদা ধরনের। তবিয়ৎ বিগড়ে যাবার কারণটা জানতে পারি কি?’
‘তোমার প্রত্যেকটি সওয়ালেরই জওয়াব দিতে হবে, এটা তো আমি জরুরী মনে করছি না।’ বলে নয়ীম চলে যেতে চাইলেন।
তার চোখের যাদুতে আকৃষ্ট হয়ে নয়ীম রাতের বেলা এমনি পায়চারী করে বেড়াচ্ছেন, হুসনেআরা এই ধারণা নিয়ে এসেছে, কিন্তু তার সে ধারণা কেমন যেনো ভূল হয়ে গেলো। এ ঘৃনা, না মুহাব্বত? সে যাই হোক, হুসনেআরা সাহস করে সামনে এগিয়ে এসে নয়ীমের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। নয়ীম অপর দিক দিয়ে চলে যেতে চাইলেন, কিন্তু সে তার জামার এক প্রান্ত ধরে ফেললো। নয়ীম ফিরে বললেন, কি চাও তুমি?’
হুসনেআরা মুখে জওয়াব যোগায় না। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। তার সকল গর্ব সে ঢেলে দিয়েছে মুজাহিদের পায়ে। নয়ীম তার কম্পিত হাত থেকে জামার প্রান্তটি ছাড়িয়ে একটি কথাও না বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন তার কামরার দিকে।
হুসনেআরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় তার দেহে ঘাম বেরিয়ে এসেছে। ঘাম মুছে ফেলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে চলে গেলে নিজের কামরায়। আয়নায় আর একবার নিজের মুখ দেখে নিয়ে রাগে শরাবের একটা সোরাহী ছুঁড়ে মারলো আয়নার উপর।
‘জংলী কোথাকার! আমি কেন ওর পায়ে পড়তে গেলাম?’ বলে আর একবার সে কামরার মধ্যে তেমনি পায়চারী করতে লাগলো বেকারার হয়ে। আমি কেন ওর পায়ে পড়লাম! কেন আমি ওর কাছে গেলাম। বলতে বলতে হুসনেআরা ভাঙ্গা আয়নার একটা টুকরা তুলে মুখ দেখে নিজের মুখের উপরে এক চাপড় মারলো। তারপর নয়ীম ছাড়া গোটা দুনিয়াকে গাল দিতে দিতে বিছানায় উপুর হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে।
এ ঘটানার এক মাস পর নয়ীম কাশগড় পৌঁছে কুতায়বার কাছ থেকে ছয় মাসের ছুটি নিলেন। আরব ও ইরানের যেসব মুজাহিদ ছুটি নিয়ে দেশে যাচ্ছে, নয়ীম হলেন তাদের সফরের সাথী। নয়ীমের পুরানো দোস্ত ওয়াকি ছিলেন এই ক্ষুদ্র কাফেলায় শামিল। নয়ীম তাঁর কাছে খুলে বলেছিলেন দীলের কথা। কয়েক মনযিল অতিক্রম করে নয়ীম কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইলে সাথীরা জানালো যে, তারা তাঁকে মনযিলে মসুদে পৌঁছে দিয়ে যাবে।
*
নার্গিস এক পাহাড়-চুড়ায় বসে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মুগ্ধকর রূপ দেখছে। যমররুদ তাঁকে দেখে পাহাড়-চুড়ায় ছুটে এলো।
নার্গিস, নার্গিস!!’
নার্গিস উঠে মরুদকে দেখে তার সাড়া দিয়ে বসে পড়লো।
নার্গিস! নার্গিস!! যমরুরুদ কাছে আসতে আসতে আবার ডাকলো।
নার্গিস, উনি এসেছেন! তোমার শাহযাদা এসেছেন!’
পাহাড়ের মাটি আচানক সোনা হয়ে গেলেও নার্গিস হয়তো এতোটা হয়রান হতো না। সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যমররুদ আবার একই কথা বললো, তোমার শাহযাদা এসে গেছেন!
নার্গিসের মুখ খুশীর দীপ্তিতে ঝলমল করে উঠলো। সে উঠলো, কিন্তু বুকের ধড়ফড়ানি ও দেহের কম্পন সংযত করতে না পেরে বসে পড়লো আবার। যমররুদ এগিয়ে এসে দু’হাতে তাকে ধরে তুললো। তারা দুজন আলিংগনা বন্ধ হলো।
‘আমার স্বপ্ন সফল হলো।’ নার্গিস লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো।
নার্গিস! আমি আরও এক খোশখবর এনেছি।’
বলো যমদ, ৰলো। এর চাইতে বড় খোশখবর আর কি হতে পারে?
আজ তোমার শাদী।
‘আজ!….না!’
নার্গিস, এখখুনি।’
নার্গিস দ্রুত এক পা পিছিড়ে দাঁড়ালো। তার আনন্দ-দীপ্ত মুখ আবার পান্ডুর হলো। সে বললো, যমররুদ! এ ধরনের ঠাট্টা ভাল নয়।