বাদশাহ্ বললেন, এ নৃত্য-গীত বুঝি আপনার ভালো গাগলো না?
নয়ীম জওয়াবে বললেন, আমাদের কানে কেবল সেই সুরই ভালো লাগে, যা তলোয়ারের ঝংকার থেকে পয়দা হয়ে। আমাদের তাহযীব নারীকে নৃত্য করবার অনুমতি দেয় না। নামাযের সময় হয়ে এলো। আমার এখখুনি যেতে হচ্ছে-’ বলে নয়ীম লম্বা লম্বা পা ফেলে দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন হুসনেআরা দরযায় দাঁড়িয়ে। নয়ীমকে আসতে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নিলো বিরক্তির সাথে। নয়ীম বেপরোয়া হয়ে, বেরিয়ে গেলেন। হুসনেআরার মনে আর একবার জাগলো পরাজয়ের অনুভুতি।
‘অতি তুচ্ছ তুমি। তোমায় আমি অন্তর দিয়ে ঘুণা করি। নয়ীমের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে সে বললো তাতারী যবানে। কিন্তু নয়ীম একবার পিছু ফিরেও তাকলেন না! সে তখন আপন মনে গর্জাতে লাগলো নিস্কল আক্রোশে। নয়ীম চলে গেলে সে ফিরে গেলো হতাশ হয়ে। যিন্দেগীতে এই প্রথমবার সে মাথা নীচু করে চললো।
রাতের বেলায় নয়ীম বিছানায় পড়ে ঘুমোবার নিষ্ফল চেষ্টা করছেন। তাঁর সাথীরা গভীর নিদ্রামগ্ন। কামরায় জ্বলছে অনেকগুলো মোমবাতি। দিনের ঘটনাগুলো বার বার তার মস্তিস্কে এসে তাকে পেরেশান করে তুলছে। হুসনেআরার কল্পনা বার বার চিন্তার গতি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নার্গিসের দেশে। দু’জনের চেহারায় কতো মিল পাথ্যক শুধু এই যে, হুসনেআরা সুন্দরী এবং সৌন্দর্যের অনুভূতিও রয়েছে তার মনে। কিন্তু সে অনুভুতি এমন বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে তার ভিতরে যে, সে তার পুরোপুরি সুযোগ নিতে গিয়ে বঞ্চিত করছে আপনাকে পবিত্রতা ও নিষ্পাপ সৌন্দর্য থেকে। তার রূপে-তার আকৃতিতে আন্তরিকতার পরিবর্তে প্রধান্য লাভ করেছে লালসা চরিতার্থ করবার অদম্য স্পৃহা।
আর নার্গিস? নার্গিস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এক সরল, নিষ্পাপ ও অকৃত্রিম প্রতিচ্ছবি। বার বার নয়ীমের মনে পড়ে নার্গিসের কাছ থেকে তাঁর শেষ বিদায়ের দৃশ্য। নয়ীমের কাছে নার্গিস তার মনের যে পরিচয় দিয়েছে, তা তিনি আজও ভোলেননি। তিনি জানেন, নার্গিসের নিষ্পাপ দীলের গভীরে তিনি পয়দা করেছেন মুহাব্বতের তুফান।
গত কয়েক মাসে কতোবার তাঁর মনে জেগেছে নার্গিসকে আর একবার দেখা দেবার ওয়াদা পূরণ করবার দূরন্ত সাধ, কিন্তু মুজাহিদের উদ্দীপনায় তা চাপা পড়ে গেছে প্রতিবার। প্রত্যেক বিজয় তার সামনে খুলে দিয়েছে নতুন অভিযানের পথ।
নয়ীম প্রত্যেক নয়া অভিযানকে শেষ অভিযান মনে করে নার্গিসের কাছে যাবার ইরাদা মূলতবী রেখেছেন প্রতিবার। কিন্তু তার নির্বিকার ঔদাসিনের কারণ শুধু তাই নয়। নয়ীমের অবস্থা সেই মুসাফিরের মাতো, দীর্ঘ সফরের পথে যে তার মূল্যবান ও জরুরি পাথেয় ডাকাতের হাতে সমর্পণ করে এমন হতাশ হয়ে যায় যে, অবশিষ্ট সামান্য জিনিসগুলোকে নিজের হাতে পথের ধুলোয় ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে শূন্য হাতে।
জোলায়খার মৃত্য আর উযরার কাছ থেকে চিরদিনের বিচ্ছেদ দুনিয়ার সুখ, শান্তি ও আরাম শব্দগুলোকে করে তুলেছে নয়ীমের কাছে অর্থহীন। যদিও নার্গিসের সাথে তার শেষ মোলাকাত এ শব্দগুলোকে আবার কিছুটা অর্থপূর্ণ করে তুলেছে, কিন্তু সে অর্থের গভীরতা তাতে ডুবে যাবার মতো যথেষ্ট নয়। নার্গিসকে তিনি যেমন করে চান, তাতে তার নৈকট্য ও দূরত্ব একই কথা। তথাপি নার্গিসের কথা ভাবতে ভাবতে কখনও কখনও তাঁর মনে হয়, সেই তাঁর যিন্দেগীর শেষ অবলম্বন। তার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদের কল্পনা তাঁর কাছে কতো ভয়ংকর!
বিছানায় শুয়ে তার মনে চিন্তা জাগে, খোদা জানেন, নার্গিস কি অবস্থায় কি ধারণা নিয়ে তার পথ চেয়ে রয়েছে। যদি সে…….জোলায়খা …….অবথা উযরার মতো, না, না, খোদা যেনো তা না করেন। নার্গিসের সম্পর্কে হাজারো চিন্তা নয়ীমকে পেরেশান করে তোলে, আর তিনি সান্ত্বনা দেন নিজের দলকে।
মানুষের স্বভাব, যখন সে গোড়ার দিকে কোনো গৌরবময় সাফল্যের অধিকার লাভ করে, হতাশার ভয়াবহ গভীরতার ভিতরেও সে তখন জ্বালিয়ে রাখে আশার দ্বীপ-শিখা। কিন্তু গোড়াতেই যে লোক ব্যর্থতার চরমে পৌঁছে গেছে, সে তো কোনো কিছুকেই বানাতে পারে না তার আশার কেন্দ্রস্থল, আর যদি তা পারেও তথাপি লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যয় সত্ত্বেও সে আশ্বস্ত হয় না। হাজারো বিপদের কল্পনা ছাড়া এক পা’ও সে এগুতে পারে না গন্তব্য লক্ষ্যের পথে, আর লক্ষ্য অর্জনের পরও তার অবস্থা হয় এক দেউলিয়া মানুষেরই মতো-যে পথের মাঝে জওয়াহেরাতের তূপ পেয়েও মালদার হবার খুশির পরিবর্তে পুনরায় সর্বস্ব হারানোর ভয়ে থাকে বিব্রত।
হাজারো চাঞ্চল্যকর চিন্তায় ঘাবড়ে গিয়ে নয়ীম ঘুমোবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দীর্ঘ সময় এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না বেকারার হয়ে তিনি পায়চারী করতে লাগলেন কামরার মধ্যে। পায়চারী করতে করতে রাতে তিনি কামরার বাইরে এসে দেখতে লাগলেন চাঁদের মুগ্ধকর স্নিগ্ধরূপ।
*
মহলের অপর দিকে এক সুদৃশ্য কামরায় হুসনেআরা আবলুস কাঠের এক কুরসীতে বসে বসে তার দেবতাদের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছেনয়মের কার্যকলাপের। তার পরিচারিকা মারওয়ারিদ সামনে এক গালিচায় বসে তার দিকে তাকিয়ে রায়েছে। হুসনেআরার দীলের মধ্যে এখনও জ্বলছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার অদম্য অগ্নিশিখা।