উযরা শরমে সাঈদের পেছনে লুকালো।
যাও বেটী!’ সাঈদ উযরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার ভাই-এর সাথে খেলো।
উযরা লাজুক মুখ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নয়ীমের হাত থেকে একটা ছড়ি নিয়ে নিলো। তারা দু’জনে.আঙিনার অপর পাশে গিয়ে নিজ নিজ কাঠের ঘোড়ায় সওয়ার হলো। তাদের মধ্যে ভাব জমতে দেরী হলো না।
নয়মের কার্যকলাপে আব্দুল্লাহ খুশী হতে পারছিলো না। সে বার বার তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে নয়ীম তার নতুন সাথীর সাথে এতটা ভাব জমিয়ে ফেলেছে যে, আব্দুল্লাহ তাদের দিকে তাকিয়ে আবার অপর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আব্দুল্লাহ যখন তাকেমুখ ভ্যাংচাতে লাগলো তখন সে আর বরদাশত করতে পারলো না।
দেখুন আম্মিজান, আব্দুল্লাহ আমায় মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। মা বললেন, আব্দুল্লাহ ওকে খেলতে দাও।
আব্দুল্লাহ গম্ভীর হয়ে গেলে নয়ীম এবার তাকে মুখ ভ্যাংচাতে শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে আব্দুল্লাহ মুখ ফিরিয়ে নিলো অপর দিকে।
*
উযরার কাহিনী সাবেরার কাহিনী থেকে কিছু আলাদা নয়। দুনিয়ায় এসে কিছু বুঝবার মতো বয়স হবার আগেই সে হারিয়ে ফেলেছে পিতা মাতার স্নেহের ছায়া।
উযরার বাপ ছিলেন ফুস্তাতের বিশিষ্ট লোকদের একজন। বিশ বছর বয়সে ইরানী মেয়ে ইয়াসমিনের সাথে হলো তাঁর শাদী। ইয়াসমিনের শাদীর পর প্রথম রাত্রি। প্রিয়তম স্বামীর কোলের কাছে থেকে সে গড়ে তুলছিলো নতুন আশা-আকাংখার নয়া দুনিয়া, কামরার মধ্যে জ্বলছিলো কয়েকটি মোমবাতি। ইয়াসমিন আর যহীরের চোখে ছিলো নেশার ঘোের, কিন্তু যে নেশা ঘুমের নেশা থেকে আলাদা।
ইয়াসমিন, সত্যি সত্যি বলো তো, তুমি খুশী হয়েছে? যহীরের মুখে প্রশ্ন। দুলহিন অনন্ত সুখের আবেশে আধো নিমীলিত চোখ দুটি একবার উপরে তুলে আবার নীচ করলো।
যহীর আবার একই প্রশ্ন করলেন। ইয়াসমিন স্বামীর মুখের দিকে তাকালো। লজ্জা ও আনন্দের গভীর আবেগে আত্মহারা হয়ে এক মুগ্ধকর হাসি টেনে এনে সে হাত রাখলো স্বামীর হাতের উপর। তার এ বাকহীন জওয়াব কতো বেশী অর্থপূর্ণ! এ সেই মুহূর্ত, যখন রহমতের ফেরেশতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে আনন্দ-গীতি আর ইয়াসমিনের কম্পিত দীল যহীরের দীলের কম্পনের জওয়াব দিচ্ছে। মুখের কথা যেনো হারিয়ে ফেলেছে তার বাস্তবতা। যহীর আবার এই প্রশ্ন করলেন।
‘আপন দীলকে প্রশ্ন করো’। ইয়াসমিন জওয়াব দিলো।
যহীর বললেন, আমার দীলের মধ্যে তো আজ খুশীর তুফান উদ্বেল হয়ে উঠছে। আমার মনে হয় যেনো আজ সৃষ্টি সব কিছুই আনন্দের সুরে মুখর। আহা! এর ঝংকার যদি চিরন্তন হতো!’
‘আহা! ইয়াসমিনের মুখ থেকে অলক্ষ্যে বেরিয়ে এলো। এক মুহূর্ত আগে তার যে কালো কালো ডাগর চোখ দুটি ছিলো আনন্দ-আবেগে উচ্ছল, ভবিষ্যতের চিন্তায় তা হঠাৎ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। যহীর প্রিয়তমা পত্নীর চোখে অশ্রু দেখে কেমন যেনো আপন ভোলা হয়ে গেলেন। •
ইয়াসমিন! ইয়াসমিন! কেঁদে ফেললে তুমি? কেন?
ণা। ইয়াসমিন হাসবার চেষ্টা করে জওয়াব দিলো। অশ্রুভেজা হাশি যেনো তার রূপের ছটা বাড়িয়ে দিলো আরো বহুগুণ।
কেন? সত্যি সত্যি তো কাঁদছো তুমি। ইয়াসমিন, কি মনে পড়লো তোমার? তোমার চোখের আঁসু দেখা যে আমার বরদাশতের বাইরে’।
একটা কথা আমার মনে এসেছিলো।’ ইয়াসমিন মুখের উপর হাসির আভা টেনে আনার চেষ্ট করে জওয়ার দিলো।
কি কথা?’ যহীর প্রশ্ন করলেন।
এমন কিছু নয়। হালীমার কথা মনে পড়েছিলো আমার। বেচারীর শাদীর পর এক বছর না যেতেই ওর স্বামী দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো।’
যহীর বললেন, এ ধরনের মওতের কথা ভেবে আমি ঘাবড়ে উঠি। বেচারা রোগে বিছানায় পা ঘসে ঘসে জান দিলো। এক মুজাহিদের মওত কতো ভালো! কিন্তু আফসোস, সে সৌভাগ্য ওর হোল না। বেচারার নিজেরও কোনো কসুর ছিলো ণা এতে। ছেলেবেলা থেকেই ও ছিলো নানারকম ব্যাধির শিকার। ওর মওতের কদিন আগে আমি যখন ওর অবস্থা জানতে গেলাম, তখন ও এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়ে রয়েছে। আমায় ও পাশে ডেকে বসালো। আমার হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, তুমি খুবই খোশ কিসমৎ। তোমার বায়ু লোহার মত মযবুত। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তুমি জংগের ময়দানে দুশমনের তীর ও নেয়ার মোকাবিলা কর, আর আমি এখানে পড়ে পা ঘসে ঘসে মরছি। দুনিয়ায় আমার আসা না আসা সমান। ছোটবেলায় আমার চোখে ছিল মুজাহিদ হবার স্বপ্ন, কিন্তু যৌবনে এসে বিছানা ছেড়ে কয়েক পা চলাও হোল আমার পক্ষে কষ্টকর।’ কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। আমি ওকে কতো সান্তনা দিলাম, কিন্তু ও ছোট ছেলের মতো কাঁদতে লাগলো। জিহাদে যাবার আকাংখা বুকে নিয়েই ও চলে গেছে, কিন্তু ওর দেহের ভিতরে ছিলো এক মুজাহিদের দীল। মওতকে ওর ভয় ছিলো না, কিন্তু এ ধরনের মওত ও চায়নি।’
যহীরের কথা শেষ হলে দু’জনই গভীর চিন্তায় অভিভূত হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।
ভোরের আভাস তখন দেখা দিচ্ছে। মুয়াযযিন দুনিয়ার মানুষের গাফলতের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে নামাযে শরীক হবার খোদায়ী হুকুম শুনিয়ে দিচ্ছে। তারা দু’জনই সেই হুকুম তামিল করবার জন্য তৈরী হচ্ছে, অমনি কে যেনো দরযায় আঘাত দিলো। যহীর দরযা খুলে দেখলেন, সামনে সাঈদ মাথা থেকে পা পর্যন্ত লৌহ আবরণে ঢেকে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রয়েছেন। সাঈদ ঘোড়া থেকে নামলেন এবং যহীর এগিয়ে গিয়ে তার বুকে বুক মিলালেন।