নয়ীম বিজয়ী বেশে দরবারে প্রবেশ করলেন। তিনি বাদশাহ ও দরবারীদের দিকে দৃষ্টি হেনে আসসলামু আলাইকুম’ বললেন।
বাদশাহ দরবারীদের দিকে আর দরবারীরা বাদশার দিকে তাকাতে লাগলেন। সালামের জওয়াব না পেয়ে নয়ীম তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন বাদশাহের দিকে বাদশাহ মুজাহিদের তেজোব্যঞ্জক দৃষ্টির সামনে দৃষ্টি অবনত করলেন। ওলী আহাদ আসন ছেড়ে উঠে নয়ীমের দিকে হাত বাড়ালেন। নয়ীম তাঁর সাথে মোসাফেহা করে তাঁর ইশারা একটি খালি কুরসিতে বসে পড়লেন।
বাদশাহ তাঁর পত্মীর দিকে তাকিয়ে তাতারী যবানে বললেন, ‘এ লোকগুলোকে দেখে আমি কৌতুক অনুভব করি। এঁরাই এসেছেন আমাদের জয় করতে। এঁর লেবাসটা দেখে নাও।’
নয়ীম জওয়াব দিলেন, সিপাহীর শক্তি তার লেবাস দিয়ে আন্দায করা যায়না, তা আদায় করতে হয় তার তলোয়ারের তেজ ও বায়ুর কুওৎ দেখে।’
চীনের বাদশার ধারণা, নয়ীম তাতারী যবান জানেন না, কিন্তু জওয়াব পেয়ে তিনি পেরেশান হলেন। তিনি বললেন, শাবাশ। তুমি তাতারী যবানও জানো দেখছি। নওজোয়ান! তোমার সাহসের প্রশংসা করি আমি, কিন্তু তোমাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বাছাই করে নিলেই হয়তো ভালো হতো তোমাদের জন্য চীন সাম্রাজের উত্তরাধিকারীকে তুর্কিস্তানের ক্ষুদ্র শাসকদের সমকক্ষ মনে করে তোমরা ভুল করছে। আমার বিদ্যুৎ গতি অশ্ব তোমাদের গর্বিত শির ধুলোয় পিষে দিবে। তোমরা যা কিছু হাতে পেয়েছে, তাই নিয়ে খুশী থাক। এমনও তো হতে পারে যে, চীন জয় করতে গিয়ে তুর্কিস্তানও হারিয়ে ফেলবে তোমরা।’
নয়ীম জোশের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ডান হাত তলোয়ারের হাতলের উপর রেখে বললেন, ‘গর্বিত বাদশাহ! এ তলোয়ার ইরান ও রুমের শাহানশাহদেরকে মিশিয়ে দিয়েছে মাটিতে। এ আঘাত সহ্য বরবার ক্ষমতা নেই আপনাদের। আপনাদের ঘোড়া ইরানীদের হাতীর চাইতে বেশী শক্তিশালী নয়।
নয়মের কথা শুনে দরবারে স্তব্ধতা ছেয়ে গেলো। বাদশাহ একটুখানি মাথা নাড়লেন। অমনি হুমনেআরা এগিয়ে এসে শারাবের জাম পেশ করে আবার গিয়ে দাঁড়ালেন নিজের জায়গায়।
এক পরিচারিকা হুসনেআরার কানের কাছে চুপি চুপি বললো, জাঁহাপনার ক্রোধ উদ্দীপ্ত হচ্ছে। এ নওজোয়ান সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’
হুসনেআরা মনোমুগ্ধকর হাসি সহকারে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললো, এর বাহাদুরী বেঅকুফীর সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এধরনের সাহসের মূল্য কি, তা জানা নেই ওর।’
বাদশাহ কয়েক ঢোক শারাব গিলে নয়ামের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নওজোয়ান আমি আর একবার তোমার সাহসের তারিফ করছি। আজ পর্যন্ত কেউ সাহস করেনি আমার দরবারে এত বড়ো কথা বলতে। আমরা তোমাদের ধর্মকে ভয় পেয়ে যাব, মনে করা ঠিক হবে না। তোমাদের বাহাদুরীর পরীক্ষাও হবে, কিন্তু আমি জানতে চাই, দুনিয়ার সব শান্তিপূর্ণ সালতানাতে কেন তোমরা পয়দা করছে অশান্তি। হুকুমাতের লোভ থাকলে আগেই তো তোমরা বহুদূর প্রসারিত সালতানাতের মালিক হয়েছে। দৌলতের লালা থাকলে আমরা তোমাদের অনেক কিছুই দেবো খুশী হয়ে। সোনা চাদি দিয়ে ভরে দিলেও আমাদের ধনভান্ডারে দৌলতের কমতি হবে না। যা খুশী, তোমরা চেয়ে নাও’।
নয়ীম জওয়াব দিলেন, আমরা আমাদের শর্ত পেশ করেছি। আপনি আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা করছেন। দুনিয়ায় বিশৃংখলা পয়দা করতে আমরা আসিনি, কিন্তু এমন শান্তির সমর্থক আমরা নই, যাতে অসহায় কমযোর মানুষ শক্তিমানের যুলুম নীরবে সয়ে যেতে বাধ্য হয়। সারা দুনিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কায়েম করতে চাই এক.বিশ্বজয়ী কানুন-যাতে শক্তিমানের হাত কমযোরকে আঘাত দিতে পারবে না, মনিব ও গোলামের প্রভেদ থাকবে না, বাদশাহ আর তাঁর প্রজাদের মধ্যে থাকবে না কোন দূরত্ব। এই কানুনই হচ্ছে ইসলাম। দৌতল ও হুকুমাতের লোভ নেই আমাদের, বরং দুনিয়ার পাশব শক্তির হাত থেকে মযলুম মানবতার হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনবার জন্যই এসেছি আমরা। আপনি হয়তো জানেন না, দুনিয়ার বিস্তীর্ণতম হুকুমাতের মালিক হয়েও আমাদের নযর নেই দুনিয়ার ঐশ্বর্য-আড়ম্বরের দিকে।’
নয়ীম কথা শেষ করে বসলেন। দরবারে আর একবার স্তব্ধতা ছেয়ে গেলো। হুসনেআরা তার পাশের পরিচারিকাকে বললো, “এই সদুৰ্শন নওজোয়ানকে দেখে আমার মনে জাগে দয়া। যিন্দেগী এর কাছে ভার হয়ে এসেছে, মনে হয়। জাহাঁপনার একটি মাত্র মামুলি ইশারা ওকে নিরব করে দেবে চিরদিনের জন্য, কিন্ত আমি দেখে হয়রাণ হচ্ছি, জাঁহাপনা আজ প্রয়োজনের চাইতে বেশি দয়ার পরিচয় দিচ্ছেন। দেখি, এর পরিণাম কি হয়। এমনি ভরা-যৌবনে মৃত্যুর পথ খোলাসা করা কতো বড়ো নির্বুদ্ধিতা।
নয়মের কথার মধ্যে বাদশাহ দু’একবার চঞ্চল হয়ে উঠে এপাশ-ওপাশ করেছেন এবং কোন জওয়াব না দিয়ে তামাম দরবারীর মুখের দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করেছেন। তারপর তাঁর পত্নীর কাছে চীনা ভাষায় কি যেনো বলে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা এ ব্যাপার নিয়ে আবার আলোচনা করবো। আজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু অবাঞ্ছিত আলোচনা হয়েছে। আমার ইচ্ছা, মজলিসে কিছুটা আনন্দ পরিবেশন করা হোক। বলে বাদশাহ হুসনেআরার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। হুসনেআরা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলো দরবারীদের মাঝখানে। নয়ীমের দিকে তাকিয়ে সে হেসে ফেললো। তার পা দুটি নৃত্য-চঞ্চল হয়ে উঠতেই সে দুটি হাত প্রসারিত করলো দু’দিকে। রেশমী পর্দার পেছন থেকে জেগে উঠলো বিচিত্র বাদ্য-ধ্বনি। স্তিমিত সুরের সাথে সাথে হুসসেআরা ধীরে ধীরে পা ফেলে তখতের কাছে এসে দুই জানুর উপর ভর করে বসে পড়লো। বাদশাহ সামনে হাত বাড়ালে হুসনেআরা সসম্ভ্রমে তাতে চুমু খেলো এবং উঠে ধীরে ধীরে পিছনে সরে যেতে শুরু করলো। বাদ্য-বাজনার আওয়াজ সহসা উঁচু হয়ে উঠলো। হুসনেআরা বিজলী চমকের মতো দ্রুতগতিতে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। তার দেহের প্রতিটি অংগ প্রত্যংগ কেমন যেন নাযুক ও মুগ্ধকর হয়ে দেখা দিলো। কখনও সে মাথা নত করে তার দীর্ঘ কেশদাম ছড়িয়ে দিচ্ছে সুন্দর মুখের উপর, আবার মাথায় নাড়া দিয়ে তা সরিয়ে নিচ্ছে পিঠের উপর এবং মুখখানিকে আবরণমুক্ত করে দর্শকদের মুগ্ধ বিস্ময় লক্ষ্য করে হাসছে। কখনও সে তার সুঢেল সফেদ বাহু মাথার উপর উঁচু করে ধরে আহত ফণিনীর মতো দোলাচ্ছে। নৃত্যের তালে কখনও সে এগুচ্ছে সামনে, আবার পিছেয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও কোমরে হাত রেখে সে সামনে ও পেছনে ঝুঁকছে, যেনো তার চুলগুলো যমিন ছুঁয়ে যায়। তার প্রতিটি অংগভংগী যেনো বিজলীর বিচিত্র খেলা। নেচে নেচে সে এক সোনার ফুলদানীর কাছে গিয়ে একটি গোলাপ তুলে নিয়ে গেলো নয়ীমের কাছে। তারপর তার সামনে বসে পড়লো দুই জানুর উপর। নর্তকীর কার্যকালাপে তখন তাঁর বুক কাঁপছে। তাঁর কান ও গাল অনুভূত হচ্ছে একটা তীব্র জ্বালা। নর্তকী ফুলটি তার ঠোঁটে লাগিয়ে দু’হাতে নিয়ে এগিয়ে ধরলো নয়ীমের সামনে। নয়ীম চোখে তুলছেন না দেখে সে হাত দুটি আরও এগিয়ে দিলো। এবার তার আঙুল দিয়ে তার বুক স্পর্শ করলো। নয়ীম তার হাত থেকে ফুলটি নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন নিচে এবং তখখুনি উঠে দাঁড়ালেন। নর্তকী অস্থিরভাবে ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো এবং মুহূর্তের জন্তু নয়ীমের দিকে রোষ দীপ্ত চাউনী হেনে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেলো দরযার রেশমী পর্দার পিছনে। হুসনেআরা চলে যেতেই বাদ্য-বাজনার আওয়ায বন্ধ হয়ে গেলো। দরবারে নেমে এলো গভীর নিস্তব্ধতা।