সমরকন্দের এক মন্দিরে ছিলো এক মহাসম্মানিত প্রস্তরমূর্তি। লোকে বলতো, সে মুর্তির গায়ে কেউ হাত লাগালে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত। কুতায়বা মন্দিরে ঢুকে ‘আল্লাহু আকবার’ তীর ধ্বনি করে একই আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলেন সে ভয়ংকর মূর্তিকে। মূর্তির পেট থেকে বেরুলো পঞ্চাশ হাজার মিসকাল সোনা। কুতায়বা যখন এমনি সাহসের পরিচয় দিয়েও দেবতার রোষ থেকে নিরাপদ রইলেন, তখন সমরকন্দের বেশুমার লোক পড়লো কালেমায়ে তওহীদ।
কুতায়বা বিন্ মুসলিম বিজয় ও খ্যাতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেলেন। হিজরী ৯৫ সালে তিনি অভিযান চালালেন ফারগানার দিকে। বহু শহর তিনি জয় করলেন। এরপর তিনি ইসলামী ঝান্ডা উড়িয়ে পৌঁছলেন কাশগড় পর্যন্ত। এর পরেই চীন সীমান্ত।
কাশগড়ে থেকে কুতায়বা শুরু কররেন চীন আক্রমণের প্রস্তুতি। চীনের শাহ্ কুতায়বার উদ্যোগ আয়োজনের খবর পেয়ে এক দূত পাঠিয়ে শান্তি আলোচনার জন্য একদল দূত প্রেরণের আবেদন জানালেন। দূত-দলের কর্তব্য পালনের যোগ্য মনে করে কুতায়বা হুবাযরা ও নয়ীম ছাড়া আরও পাঁচজন অভিজ্ঞ অফিসারকে মনোনীত করলেন চীন যাবার জন্য।
*
চীনের বাদশার দূতাবাসে হুবায়রা, নয়ীম ও তাঁদের সাথীরা এক মনোরম গালিচার উপর বসে আলাপ আলোচনা করছেন।
কুতায়বাকে কি খবর পাঠান যায়? হুবায়রা নয়ীমের কাছে প্রশ্ন করলেন, চীনের বাদশার লশকর আমাদের মোকাবিলায় অনেক বেশি। আপনি লক্ষ্য করেছেন, কতটা গর্ব সহকারে তারা আমাদের সামনে এসেছে!
নয়ীম জওয়াবে বললেন, শাহে ইরানের চাইতে বেশী ক্ষমতা গর্বিত নয় এরা। ক্ষমতার দিক দিয়েও এরা তার চাইতে বড় নয়। এখানকার আরামপিয়াসী ভীতু সিপাহীরা আমাদের ঘোড়ার খুরের দাপটেই ভয় পেয়ে পালাবে। আমাদের শর্ত পেশ করে দিয়েছি আমরা, তার জওয়াবের ইতেযার করুন। আপাততঃ কুতায়বাকে লিখে দিন যে, চীন জয়ের জন্য নতুন ফউজের প্রয়োজন হবে না। লড়াই যদি, করতেই হয়, তাহলে তুর্কিস্তানে যে ফউজ মওজুদ রয়েছে, এদেশ জয় করার জন্য তারাই হবে যথেষ্ট।
এক সভাসদ কামরায় প্রবেশ করে নত মস্তকে হুবায়রা ও তাঁর সাথীদের সালাম জানিয়ে বললেন, ‘জাঁহাপনা আর একবার আপনাদের সাথে আলাপ করতে চাচ্ছেন।
হুবায়রা জওয়াব দিলেন, আপনি গিয়ে বাদশাহকে বলেন, আমাদের শর্তে কোন রদবদল করবো না আমরা। আমাদের শর্ত মনযুর না হলে আমাদের মধ্যে তলোয়ার দিয়েই বিরোধ মীমাংসা হবে।
‘জাঁহাপনা শর্ত ছাড়া আরও কিছু জানতে চান আপনাদের কাছে। আপনাদের মধ্যে একজনকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে আমার উপর। অতদূর থেকে ধন-দৌলতের আকাংক্ষায় লুটপাট করতে করতে আপনারা এখানে এসেছেন, তাই আঁহাপনা আমাদেরকে কিছু ধন-দৌলত উপহার দিয়ে বন্ধুর মত বিদায় করতে চান। আরও তিনি কিছু জানতে চান আপনাদের দেশ ও কওম সম্পর্কে। নয়ীম তাঁর তলোয়ার সভাসদকে দিয়ে বললেন, ‘এখানি নিয়ে যান। এ আপনাদের বাদশার যে কোন সওয়ালের জওয়াব দেবে।
‘আপনার তলোয়ার?’ সভাসদ হয়রাণ হয়ে বললেন।
হাঁ, আপনার বাদশাহকে বলবেন, এই তলোয়ারের মুখেই আমাদের কওমের তামাম ইতিহাস লেখা হয়েছে, এবং তাকে আরও বলবেন যে, তাঁর তামাম ধন ভান্ডারকে আমরা মুজাহিদের ঘোড়ার পায়ের ধুলার সমানও মনে করি না।’
সভাসদ লজ্জিত হয়ে বললেন, জাঁহাপনার মকসুদ আপনাদের নারায করা নয়। আপনাদের সাহসের তারিফ করেন তিনি। আপনারা আর একবার মোলাকাত করুন, আমার বিশ্বাস, তার ফল ভালই হবে। হুবায়রা নয়ীমকে আরবী জবানে বললেন, বাদশাহকে আর একবার সুযোগ দেওয়া আমাদের উচিত। আপনি গিয়ে তবলীগ করুন।
নয়ীম জওয়াব দিলেন, আপনি আমার চাইতে বেশি অভিজ্ঞ।’
আমি আপনাকে পাঠাচ্ছি, তার কারণ, আপনার জবান ও তলোয়ার-দুই-ই সমান তীক্ষ্ণধার। আপনার আলাপ আমার চাইতে বেশী কার্যকরী হবে।
শুনে নয়ীম উঠে সভাসদের সাথে চললেন।
দরবারে প্রবেশের আগে এ শাহী গোলাম সোনার পাত্রে একটি বহুমূল্য পোষাক নিয়ে হাযির হলো, কিন্তু নয়ীম তা পরিধান করতে অস্বীকার করলেন। সভাসদ বললেন, আপনার কামিয বড়ই পুরানো। আপনি বাদশার দরবারে যাচ্ছেন।
নয়ীম জওয়াব দিলেন, ‘এ সব দামী লেবাস আপনাদেরকে বাদশার দরবারে মাথা নত করতে বাধ্য করে, কিন্তু আপনি দেখবেন, আমার পুরানো জীর্ণ কামিয আমায় আপনাদের বাদশার সামনে মাথা নীচু করতে দেবে না।’
নয়ীমের মোটা শক্ত চামড়ার জুতোজোড়াও ধুলি-মলিন। এক গোলাম নূয়ে পড়ে রেশমী কাপড় দিয়ে তা সাফ করে দিতে চাইলো। নয়ীম তার বায়ু ধরে তুলে দিয়ে কিছু না বলেই এগিয়ে চললেন।
চীনের বাদশাহ তাঁর পত্নীকে সাথে নিয়ে এক সোনার তখতে সমাসীন। তাঁর পাভুর মুখের উপর বার্ধক্যের রেখা সুস্পষ্ট। তাঁর পত্নী যদিও অর্ধবয়সী তথাপি তার সুডৌল মুখের উপর অতীত যৌবনের বিগত বসন্তের রূপের আভাস এখনো মিলিয়ে যায়নি। তিনি ফারগানার শাহী খান্দানের সাথে সম্পর্কিত। চীনা নারীদের তুলনায় তাঁর মুখশ্রী অধিকতর কমনীয়। রাজ্যের ওলী আহাদের গলায় জওয়াহেরাতের এক বহুমূল্য মালা। বাদশার ডান দিকে একদল সুন্দরী পরিচারিকা শারাবের জাম ও সোরাহী নিয়ে দন্ডায়মান। তাদের মাঝখানে হুসনেআরা নামী এক ইরানী নর্তকী। রূপলাবণ্যে সে অপর পরিচারিকাদের থেকে অসামান্য। তার দীর্ঘ সোনালী কেশদাম ছড়িয়ে আছে কাঁধের উপর দিয়ে। তার মাথায় সবুজ রঙের এক রুমাল। গায়ে কালো রঙের কামি। কোমরের উপর দিকে তা দেহের সাথে এমন আঁটসাট হয়ে আছে যে, তার উন্নত বক্ষযুগল সুস্পষ্টভাবে নযরে পড়ে। নীচে উজ্জ্বল রঙের ঢিলা পাজামা। হুসনেআরা আর সব মেয়েদের তুলনায় উঁচু।