নার্গিস তার আপন চিন্তায় বিভোর, অমনি পেছনে থেকে যমররুদ নিঃশব্দ পদক্ষেপে এসে পাথর তুলে মারলো পানির উপর। উছলে ওঠা পানির ছিটা এসে পড়লো নার্গিসের কাপড়ের উপর। নার্গিস ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো পেছন দিকে। যমররুদ অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো, কিন্তু নার্গিসের দিকে থেকে কোন সাড়া এলো না। যমররুদ হাসি সংযত করে মুখের উপর নার্গিসেরই মতো গাম্ভীর্য টেনে এনে তার কাছে এসে বসলো।
নার্গিস! আমি তোমায় আজ বহুত খুঁজছি। এখানে কি করছো তুমি?
কিছুই না। নার্গিস একহাতে পানি নিয়ে খেলতে খেলতে জওয়াব দিলো।
তুমি আর কতকাল এমনি করে তিলে তিলে জান দেবে। তোমার দেহ যে আধখানা হয়ে গেছে। কি রকম পাভুর হয়ে গেছে। তুমি।
যমরুরদ! বার বার আমায় বিরক্ত করো না। যাও।’
‘আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করতে আসিনি, নার্গিস! তোমায় দেখে আমি কতটা পেরেশান হয়েছি, তা খোদাই জানেন।
যমররুদ নার্গিসের গলায় বাহু বেষ্টন করে তার মাথাটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। নার্গিসও এক রুগ্ন বাচ্চার মত তার কাছে নিজকে সমর্পণ করে দিলো।
হায়! আমি যদি তোমার জন্য কিছু করতে পারতাম!’ যমররুদ নার্গিসের পেশানীর উপর হাত বুলাতে বুলাতে বললো। নার্গিসের চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ব্যাথাতুর কণ্ঠে সে বললো, আমার যা হবার, হয়ে গেছে। পাহাড়-চূড়ার মুগ্ধকর দৃশ্য আমি দেখেছি, কিন্তু দুর্গম পথের চিন্তা করিনি। যমররুদ! উনি আমার জন্য নন। আমি তাঁর যোগ্যই নই। তাঁর সম্পর্কে কোনও নালিশও নেই আমার। হয়তো আমার মতো হাজারো মেয়ে তার পায়ের ধূলাকে চোখের সুরমা বানাবার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু ….কেন তিনি এলেন এখানে? যদি এলেন তো কেন চলে গেলেন? কেন তাকে দেখেই আমি এমন বেকারার-এমন পেরেশান হলাম? আমি তাঁকে সব কিছুই খুলে বলতাম, কিন্তু তাঁর কোন শক্তি আমার যবানকে এমন করে দাবিয়ে রাখলো? তিনি আমাদের থেকে অনেক খানি স্বতন্ত্র, জেনে-শুনেও কেন আমি নিজকে তার পায়ে সঁপে দিতে চেষ্টা করলাম? এ পরিণামের ভয় আমি করেছি, কিন্তু হায়! ভয় যদি আমায় ফিরিয়ে রাখতো! যমররুদ! ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্ন দেখেছি আসমান থেকে এক শাহযাদা নেমে আসবেন, আমি তার কাছে দীল-যবান সমর্পন করে দিয়ে আপনার করে নেবো তাঁকে। আমার শাহযাদা এলেন, কিন্তু তাঁকে আমি আপনার করে নিতে পারিনি ভয়ে। যমররুদ! এও কি এক স্বপ্ন? এ স্বপ্নে কি কোন অর্থ আছে? যরূরুদ! যমররুদ!! আমার কি হলো? তুমি কি এখনও বলবে, আমি সবর করিনি? হায়, সবর করবার ক্ষমতা যদি আমার থাকতো।’
নার্গিস! প্রত্যেক স্বপ্নের সাফল্যের সময় ঠিক থাকে। অনন্ত হতাশার মধ্যেও ইনতেযার আর উম্মীদ হবে আমাদের শেষ অবলম্বন। খোদার কাছে দো’আ করো।
এমনি বিলাপ করে কোন ফায়দা নেই। ওঠ, এবার ঘুরে আসিগে’।
নার্গিম উঠে যমররুদের সাথে সাথে চললো। কয়েক কদম চলতেই ডান দিকে এক সওয়ারকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখা গেলো। সওয়ার তাদের কাছে এসে ঘোড়া থামালেন। তাঁকে দেখে যমররুদ চীৎকার করে বললো, নার্গিস! নার্গিস!! তোমার শাহযাদা এলেন! নার্গিস নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার দীলের রাজ্যের বাদশাহ্ তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেনো। অন্তহীন খুশী অথবা অন্তহীন বিষাদের ভিতরে মানুষ যেমন নিশ্চল হয়ে যায়, নার্গিসের অবস্থাও তাই। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নবেশে চলবার মত দু’তিন কদম সামনে গিয়েই সে পড়ে গেলো যমিনের উপর। নয়ীম তখখুনি ঘোড়া থেকে নেমে নার্গিসকে ধরে তুললেন।
নার্গিস! কি হলো তোমার?
‘কিছু না।’ নার্গিস চোখ খুলে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে জওয়াব দিলো।
‘আমায় দেখে ভয় পেলে তুমি?’
নার্গিস কোন জওয়াব না দিয়ে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে। এতো কাছে থেকে তাঁকে দেখা তার প্রত্যাশার অতীত, কিন্তু নয়ীম.তার অবস্থা সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে দু’তিন কদম দূরে সরে দাঁড়ালেন। নার্গিস তার আঁচলে আসা ফুলের বিচ্ছেদ বরদাশত করতে পারলো না। তার দেহের প্রতি শিরা উপশিরায় জাগলো এক অপূর্ব কম্পন। নারীসূল সংকোচের বাঁধা কাটিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে মুজাহিদের পায়ের উপর ঝুকলো।
নয়ীমের সংযম বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তিনি নার্গিসের বায়ু ধরে তুলে যমরুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যমররুদ! একে ঘরে নিয়ে যাও।’
নার্গিস একবার নয়ীমের দিকে, আবার যমররুদের দিকে তাকাতে লাগলো। তার চোখ থেকে নামলো অশ্রুর বন্যা। সে মুখ ফিরিয়ে নিলো অপর দিকে। তারপর একবার নয়ীমের দিকে ফিরে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরের দিকে চললো। নয়ীম যমররুদের দিকে তাকালেন। সে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।
নয়ীম বিষণ্ণ স্বরে বললেন, যাও যমররুদ, ওকে সান্ত্বনা দাওগে।’
যমররুদ জওয়াব দিলো, “কেমন সান্ত্বনা? আপনি এসে ওর শেষ অবলম্বনটুকুও ভেঙে চুরমার করে দিলেন। এর চাইতে না আসাইতো ছিলো ভালো।’
‘আমি হুমানের সাথে দেখা করতে এসেছি। সে কোথায়?
‘সে গেছে শিকার করতে।’
‘তা হলে ঘর পর্যন্ত যাওয়া আমার পক্ষে নিরর্থক। হুমানকে আমার সালাম দিয়ে বলবে, নিরুপায় বলেই আমি দেরী করতে পারিনি। আমাদের ফউজ এগিয়ে যাচ্ছে ফারগানার দিকে।
কথাটি বলেই নয়ীম ঘোড়ায় সওয়ার হলেন, কিন্ত যমররুদ এগিয়ে গিয়ে ঘোড়ার বাগ ধরে বললো, আমি মনে করেছিলাম, আপনার চাইতে নরমদীল মানুষ আর নেই, কিন্তু আমার ধারণা ভুল। আপনি মাটির তৈরী নন, আর কোন জিনিষের তৈরী। এখন বদনসীবের দেহে জানটুকুও বাকী রইলো না।’