‘আপনি বলুন।
উযরা, একটি নামই তো আমার ভাল লাগে।’
বলুন!’
নয়ীম!’ আব্দুল্লাহ বিষণ্ণ আওয়াযে জওয়াব দিলেন।
শুনে উমরার চোখ দুটি খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, আমার একিন ছিলো যে, এই নামই আপনি পছন্দ করবেন তাই আগেই আমি ওর এই নাম রেখে দিয়েছি।’
*
নার্গিসদের বস্তি থেকে বিদায় নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ পথ অতিক্রম করে নয়ীম তাতারী পশু-পালকদের এক বস্তিতে গিয়ে রাত কাটালেন। সেখানকার লোকদের চালচলন ও রীতিনীতির সাথে তিনি পরিচিত। তাই আশ্রয়স্থান খুঁজে নিতে অসুবিধা হয়নি তার। বস্তির সরদার তাঁকে ইসলামী ফউজের এক অফিসার মনে করে যথাসম্ভব আদর আপ্যায়ন করলো! সন্ধ্যায় খানা খেয়ে নয়ীম বেরুলেন ঘুরতে। বস্তি থেকে কিছুদুর যেতেই শোনা গেলো ফউজী নাকারার আওয়ায। পিছু ফিরে তিনি দেখলেন, গায়ের লোকেরা ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে এদিক ওদিক নয়ীম ছুটে তাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন তাদের পেরেশানীর কারণ।
গাঁয়ের সরদার বললো, নাযকারের সেনাবাহিনী মুসলমানদের লশকরের উপর ব্যর্থ হামলা করে পিছু হটে এসে এগিয়ে যাচ্ছে ফারগানার দিকে। আমি খবর পেয়েছি যে, তাদের রাস্তায় যে বস্তিই আসছে, তার উপর তারা চালাচ্ছে লুটপাট। আমার ভয় হচ্ছে, তারা এ পথ দিয়ে গেলে আমাদের ভীষণ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আপনি এখানেই থাকুন। আমি ওই পাহাড়ে চড়ে তাদের খোঁজ নিচ্ছি। নয়ীম বললেন, আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে।
নয়ীম ও তাতারী সরদার ছুটে চলে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়। সেখান থেকে দেড়ক্রোশ দূরে তাতারী লশকর আসতে দেখা গেলো। সরদার খানিকক্ষন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর খুশীতে উছলে উঠে বললো, সত্যি বলছি, ওরাঁ এদিকে আসবে না। ওরা ভিন্ন পথ ধরেছে। খানিকক্ষণ আগেও আমি মনে করেছি যে, আপনার আগমন আমাদের জন্য এক অশুভ ইংগিত, কিন্তু এখন আমার একিন জন্মেছে, আপনি মানুষ নন, এক আসমানী দেবতা। আপনার কারামতেই এই ক্ষুধিত নেকড়ের দল আমাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। এই কথা বলে সে নয়ীমের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেমে গেলো নীচের দিকে। বস্তির লোকদের সে খোশখবর শোনালো। অমনি তারা সবাই চাক্ষুষ দেখবার জন্য উঠে গেলো পাহাড়ের উপর।
গোধূলির স্নান আভা মিশে গেলো রাতের অন্ধকারে। বস্তির খানিকটা দূরে ফারগানা গামী রাস্তায় ফউজের অগ্রগতির অস্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। ঘোড়ার আওয়ায ও নাকারার ধ্বনি ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসে। বস্তির লোকেরা আশ্বস্ত হয়ে হল্লা করে, দাপাদাপি করে, নেচে গেয়ে ফিরে এলো বস্তি দিকে।
এশার নামায শেষ করে শুয়ে পড়তেই নয়ীমের চোখে নামলো গভীর ঘুম। স্বপ্নের আবেশে মুজাহিদ আর একবার দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তীরবৃষ্টি ও তলোয়ারের হামলা উপেক্ষা করে দুশমনের সারি ভেদ করে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। ভোরে উঠে নামায পড়ার পর তিনি রওয়ানা হলেন মনযিলে মকসুওদের দিকে।
আরও কয়েক মনযিল অতিক্রম করে যাবার পর একদিন ইসলামী লশকরের তাঁবু নয়ীমের ন্যরে পড়লো। মরভ থেকে তার লশকর অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে যাওয়ায় তিনি হয়রান হয়েছিলেন। তথাপি তার ধারণা হলো, হয়তো তাতারীদের হামলা তাদেরকে সময়ের আগেই এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
কুতায়বা বিন মুসলিম বাহেলী তার প্রিয় সালারকে জানালেন সাদর অভ্যর্থনা। অন্যান্য সালাররাও তাঁর আগমনে অসীম আনন্দ প্রকাশ করলেন।
নয়ীমকে অনেক প্রশ্ন করা হলো। তার জওয়াবে তিনি সংক্ষেপে শোনালেন তার কাহিনী। তারা নয়ীম পর কয়েকটি প্রশ্ন করলেন কুতায়বা বিন মুসলিমের কাছে। জওয়াবে তিনি জানান যে, কুতায়বা তাতারীদের পরাজিত করে নাযযাকের পিছু ধাওয়া করছেন।
রাতের বেলায় কুতায়বা বিন মুসলিম তার সালার ও মন্ত্রণাদাতাদের মজলিসে অগ্রগতির বিভিন্ন পরামর্শ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। নয়ীম তাকে বুঝালেন যে, ইবনে সাদেক তার নতুন চক্রান্তের কেন্দ্র করে তুলবে এবার ফারগানাকে। তাই তার অনুসরণ করতে দেরী করা উচিত হবে না।
ভোরবেলা সেনাবাহিনীর অগ্রগতির জন্য কারা বেজে উঠলো। কুতায়বা সেনাদলকে দু’ভাগে বিভক্ত করে এগিয়ে যাবার জন্য দুটি ভিন্ন রাস্তা নির্দেশ করে দিলেন। অর্ধেক ফউজের নেতৃত্ব থাকলো তাঁর নিজের উপর আর বাকী অর্ধেকের নেতৃত্ব সোপর্দ করলেন তাঁর ভাইয়ের উপর। নয়ীম ছিলেন দ্বিতীয় দলের শামিল। পথ-ঘাটের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে নয়ীমের জানা আছে বলেই কুতায়বার ভাই তাঁকে রাখলেন অগ্রগামী সেনাদলে।
*
নার্গিস এক পাথরের উপর বসে ঝরণার স্বচ্ছ পানি নিয়ে খেলছে। ছোট ছোট কাঁকর তুলে সে ছুঁড়ে ফেলছে পানিতে, তারপর কি করে তা ধীরে ধরে পানির তলায়। চলে যাচ্ছে, তাই সে দেখছে আপন মনে। একটি কাঁকর এমনি করে তলায় গিয়ে পৌঁছলে সে আর একটি ছুঁড়ে মারছে পানির উপর। কখনো বা তার মন এ খেলা থেকে সরে গিয়ে নিবিষ্ট হচ্ছে সামনের ময়দানের দিকে। ময়দানের বিস্তীর্ণ প্রসারের শেষে ঘন গাছপালার সবুজ লেবাসে ঢাকা পাহাড়রাজি দন্ডায়মান। এসব পাহড়ের পরেই উঁচু উঁচু পাহাড়ের সফেদ বরফ ঢাকা চুড়াগুলো পড়ে নজরে। বসন্ত মওসুমের সূচনা করে মুগ্ধকর হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ডান দিকে সেব গাছ আর আঙ্গুর লতায় ফল ধরতে শুরু করেছে।