তা হলে হয়তো থাকতে পারেন, কিন্তু ঠিক বলতে পারি না। তবু আপনারা ওঁকে বলে দেখুন। উনি যেদিন এলেন, সেদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে যেনো দুনিয়ার বাদশাহী পেয়ে গেছি। আপনারা বয়সে আমার বড়ো, আপনারা অবশ্য চেষ্টা করুন। আপনাদের কথা উনি মানতেও পারেন।
নয়ীম বর্ম-পরিহিত অস্ত্র সজ্জিত হয়ে এলেন। তাঁকে আজ সত্যি মনে হচ্ছে যেনো এক শাহযাদা। গাঁয়ের লোকেরা তাকে দেখেই সমস্বরে কোলাহল শুরু করলো, যেতে দেবো না আমরা, কিছুতেই যেতে দেবো না।’
নয়ীম তাঁর বিশ্বস্ত মেযবানদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং খানিক্ষণ নীরব থেকে হাত বাড়িয়ে দিলে তারা সবাই চুপ করলো।
নয়ীম এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন,’বেরাদারণ! কর্তব্যের আহবানে বাধ্য না হলে আমার আরও কিছু দিন এখানে থাকতে আপত্তি হতো না, কিন্তু আপনাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে, জিহাদ এমন এক ফরয, যাকে কোনো অবস্থায়ই উপেক্ষা করা যায়না। আপনাদের মুহব্বতের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আশা করি, খুশী হয়ে আপনারা আমায় এজাযত দেবেন।’
নয়ীম তার কথা শেষ না করতেই একটি ছোট ছেলে চীৎকার উঠলো, “আমরা যেতে দেবো না।’ নয়ীম এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বললেন, আপনাদের উপকার হামেশা আমার মনে থাকবে। এ বস্তির কল্পনা হামেশা আমার মন আনন্দে ভরপুর করে রাখবে। এ বস্তিতে আমি এসেছি অপরিচিত। আজ এই কয়েক হফতার পর এখান থেকে বিদায় নিতে গিয়ে আমি অনুভব করছি যে, আমি আমার প্রিয়তম ভাইদের কাছ থেকে জুদা হয়ে যাচিছ। আল্লাহ চাহেতো আর একবার আমি এখানে আসবার চেষ্টা করবো।’
এরপর নয়ীম তাদেরকে কিছু উপদেশ দিয়ে দো’আ করে সকলের সাথে মোসাফেহা করতে শুরু করলেন। হুমান ও আর সব লোকদের মতো রাষী হলো তার মরীর বিরুদ্ধে। নয়ীমের জন্য সে নিয়ে এলো তার খুবসুরত সাদা ঘোড়াটি এবং নেহায়েত আন্তরিকতা সহকারে অনুরোধ করলো এ তোহফা কবুল করতে।
নয়ীয় তাকে শোকরিয়া জানালেন। হুমানও গাঁয়ের আরও পনেরো জন নওজোয়ান নয়ীমের সাথে যেতে চাইলো জিহাদে যোগ দিতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর ছাউনীতে পোঁছে প্রয়োজন মতো নয়ীম তাদেরকে ডেকে পাঠাবেন, এই ওয়াদা পেয়ে তারা আস্বস্ত হলো। বিদায় নেবার আগে নয়ীম এদিক ওদিক তাকালেন, কিন্তু নার্গিসকে দেখতে পেলেন না। তার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে তিনি যেতে চান না, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার কথা কারুর কাছে জিজ্ঞেস করাটাও ভালো দেখায় না।
হুমানের সাথে মোসাফেহা করতে গিয়ে একবার তাকালেন মেয়েদের ভিড়ের দিকে। নার্গিস হয়তো তাঁর মতলব বুঝে ফেলেছে। তাই সে ভিড় থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে দাঁড়ালো নয়ীমের কাছে থেকে কিছুটা দূরে। নয়ীম ঘোড়ার সওয়ার হয়ে নার্গিসের দিকে হানলেন বিদায়ী দৃষ্টি। এই প্রথম বার নয়ীমের চোখের সামনে দৃষ্টি অবনত হলো না। এক পাথরের মূর্তির মতো নিঃসাড় নিশ্চল হয়ে এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো নয়ীমের মুখের দিকে। তার মুখে ফুটে উঠেছে এক অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তি, কিন্তু চোখে তার অশ্রু নেই। বেদনার আতিশয্যে চোখের পানি শুকিয়ে যায়, তা জানা আছে নয়ীমের। তিনি যেন সইতে পারেন না এ মর্মদ দৃশ্য। তাঁর দীল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তবু থেকে যাওয়া তার পক্ষে মুশকিল। নয়ীম আর একদিকে মুখ ফিরালেন। হুমান ও গাঁয়ের আরও কতো লোক তার সাথে যেতে চাইলে কিছুদূর, কিন্তু তাদেরকে মানা করে তিনি ঘোড়া ছুটালেন দ্রুত গতিতে।
উঁচু উঁচু টিলায় চড়ে লোকেরা দেখতে লাগলো নয়ীমের চলে যাবার শেষ দৃশ্য; কিন্তু নার্গিস সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার পা যেন যমিনে বসে গিয়েছে, নড়বার শক্তিও যেনো নেই তার। কয়েকজন সখী এসে জমা হলো তার পাশে। তার সব চাইতে অন্তরংগ ও ঘনিষ্ঠ যমররুদ বিষণ্ণ মুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গাঁয়ের মেয়েদের জমা হতে দেখে সে বললো তোমার কি দেখছো এখানে? নিজ নিজ কেউ কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। যমররুদ নার্গিসের কাঁধে হাত রেখে বললো, চল নার্গিস!’
নার্গিস চমকে উঠে যমররুদের দিকে তাকালো। তারপর কোন কথা না বলে তার সাথে সাথে খিমার ভিতর প্রবেশ করলো। নয়ীম যে পুস্তিনটি ব্যবহার করতেন, তা সেখানেই পড়েছিল নার্গিস বসতে বসতে সেটি হাতে তুলে নিলো। পুস্তিনটি দিয়ে মুখ ঢাকতেই তার দু’চোখ বেয়ে নামলো অশ্রুর বন্যা। যমররুদ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো তার পাশে। অবশেষে নার্গিসের বায়ু ধরে নিজের দিকে টেনে এনে সে বললো, নার্গিস! তুমি হতাশ হলে? উনি কতবার ওয়ায করতে গিয়ে বলেছেন, খোদার রহমত সম্পর্কে কখখনো হতাশ হতে নেই। প্রার্থীকে তিনি সব কিছুই দিতে পারেন। ওঠ নার্গিস, বাইরে যাই। তিনি নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।
নার্গিস, অশ্রু মুছে ফেলে যমররুদের সাথে বেরিয়ে গেলো। বস্তির সব কিছুই তার চোখে হয়ে এসেছে ম্লান।
*
দুপুরের সূর্য নীল আসমানে পূর্ণ গৌরবে তার কিরণ-জাল বিকিরণ করছে। বস্তির বাইরে এক খেজুর-কুঞ্জের ঘন ছায়ায় কয়েকটি লোক জমা হয়েছে। তাদের মধ্যে কতক লোক বসে কথা বলছে, আর বাকী লোকেরা পড়ে ঘুমুচ্ছে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে কুতায়বা, মুহাম্মদ বিন্ কাসিম ও তারিকের বিজয় কাহিনী।