নয়ীমের মত আত্মসচেতন লোকের পক্ষে নার্গিসের দীলের অবস্থা আন্দায করা মোটেই মুশকিল ছিলো না। মানুষের মন জয় করবার.যে শক্তি তার ভিতরে রয়েছে তা তাঁর অজানা নেই, কিন্তু এ বিজয়ে তিনি খুশী হবেন কিনা, তার মীমাংসা করে উঠতে পারে না আপন মনে।
একদিন এশার নামাযের পর নয়ীম হুমানকে তাঁর কামরায় ডেকে ফিরে যাবার ইরাদা জানালেন। হুমান জওয়াবে বললো, ‘আপনার মরযীর খেলাফ আপনাকে বাঁধা দেবার সাহস নেই আমার, কিন্তু আমায় বলতেই হবে যে, বরফ-ঢাকা পাহাড়ী পথ এখনও সাফ হয়নি। কমসেকম আরও একমাস আপনি দেরী করুন। মওসুম বদল হলে সহজ হবে আপনার সফর।’
নয়ীম জওয়াব দিলেন, বরফপাতের মওসুম তো এখন শেষ হয়ে গেছে, আর সফরের ইরাদা আমার কাছে সমতল ও বন্ধুর দুর্গম পথ একই রকম করে দেয়। আমি কাল ভোরেই চলে যাবার ইরাদা করে ফেলেছি।’
‘এত জলদী! কাল তো আমরা যেতে দেবো না!’
‘আচ্ছা, ভোরে দেখা যাবে। বলে নয়ীম বিছানার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। হুমানা উঠলো নিজের কামরায় যাবার জন্য। পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে নার্গিস। হুমানকে আসতে দেখে সে দাঁড়িয়ে গেলো গাছের আড়ালে। হুমান অপর কামরায় চলে গেলে নার্গিসও এসে তার পিছু পিছু ঢুকলো।
‘নার্গিস, বাইরে ঠান্ডা। এর মধ্যে তুমি কোথায় ঘুরছো?’ হুমান বললো।
‘কোথাও না, এমনি বাইরে ঘুরছিলাম আর কি!’ নার্গিস জওয়াব দিলো। কামরাটি নয়ীমের বিশ্রামের কামরা থেকে একটুখানি দূরে। মেঝের উপর শুকনো ঘাস বিছানো কামরার এক কোণে শুয়ে পড়লো হমান, অপর কোণে নার্গিস।
হুমান বললো, নার্গিস, উনি কাল চলে যাবার ইরদা করছেন।’
নার্গিস আগেই নিজের কানে নয়ীম ও হুমানের কথাবার্তা শুনেছ, কিন্তু ব্যপারটা তার কাছে এমন নয় যে, সে চুপ করে থাকবে।
সে বললো তা তুমি ওঁকে কি বললে?
‘আমি ওকে দেরি করতে বললাম, কিন্তু ওঁকে অনুরোধ করতেও ভয় লাগে আমার। উনি চলে গেলে গাঁয়ের লোকেরও আফসোস হবে খুবই। ওদেরকে আমি বলবো সবাই মিলে ওঁকে বাধ্য করবে থেকে যেতে।
হুমান নার্গিসের সাথে কয়েকটি কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়লো। নার্গিস বারংবার পাশ ফিরে ঘুমোবার ব্যর্থ চেষ্টা করবার পর উঠে বসলো। উনি যদি চলেই যাবেন এমনি করে, তাহলে এলেন কেন?’ এই কথা ভাবতে ভাবতে সে বিছানা ছেড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে কদম ফেলে কামরার বাইরে নয়ীমের কামরার চারদিকে ঘুরে দেখলো। তার পর ভয়ে ভয়ে দরযা খুলালো, কিন্তু সামনে কদম ফেলবার সাহস হলো না। ভিতরে মোমবাতি জ্বলছে আর নয়ীম পুস্তিনে গা ঢেকে ঘুমোচ্ছে। তাঁর মুখ চিবুক পর্যন্ত খোলা। নার্গিস আপন মনে বললো, শাহযাদা আমার, তুমি চলে যাচ্ছো! জানি না, কোথায় যাচ্ছো। তুমি, তুমি কি জানো, তুমি কি ফেলে যাচ্ছো
এখানে, আর কি নিয়ে যাচ্ছে, এই পাহাড়, এই চারণভূমি, বাগ-বাগিচা আর ঝরণার সবটুকু সৌন্দর্য, সবটুকু তুমি নিয়ে যাবে তোমার সাথে, আর এখানে পড়ে থাকবে তোমার স্মৃতি। ……শাহযাদা…….শাহযাদা আমার………. না, না, তুমি আমার নও, আমি তোমার যোগ্য নই।ভাবতে ভাবতে সে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সে আবার ঢুকলো কামরার ভিতরে এবং নিশ্চল-নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলো। নয়ীমের দিকে।
আচানক নয়ীম পাশ ফিরলেন। নার্গিস ভয় পেয়ে বেরিয়ে নিঃশব্দ পদক্ষেপে নিজের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ওহ, রাত এত দীঘ!’ কয়েকবার উঠে উঠে সে আবার শুয়ে পড়ে বললো আপন মনে।
ভোরে এক রাখাল আযান দিলো। বিছানা ছেড়ে নয়ীম ওযু করতে গেলেন ঝরণার ধারে। নার্গিস আগে থেকেই রয়েছে সেখানে। তাকে দেখেও নয়ীমের কোন ভাবান্তর হলো না। তিনি বললেন, নার্গিস, আজ তুমি সকালে এসে গেছে এখানে?
রোজ নার্গিস এই গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে নয়ীমকে। আজ সে নয়ীমের নির্বিকার ঔদাসীন্যের জন্য অভিযোগ জানাতে তৈরী হয়ে এসেছে, কিন্তু নয়ীম বেপরোয়া হয়ে আলাপ করা তার উৎসাহের আগুন নিভে গেলো। তথাপি সে সংযত হয়ে থাকতে পারলো না। অশ্রুসজল চোখে সে বললো আপনি আজই চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ নার্গিস, এখানে এসে আমার বহুত দিন কেটে গেলো। আমার জন্য কত খলীফই না করলে তোমরা। হয়তো আমি তার শোকরিয়া জানাতে পারবো না। খোদা তোমাদেরকে এর প্রতিদান দিন।’
কথাটি বলে নয়ীম একটা পাথরের উপর বসে ওযু করতে লাগলেন ঝরণার পানিতে। নার্গিস আরও কিছু বলতে চায়, কিন্তু নয়ীমের কার্যকলাপ তার উৎসাহ নিভিয়ে দেয়। দীলের মধ্যে যে ঝড় বইছিলো তা থেমে আসে। গাঁয়ের বাকী লোকেরা ঝরণার কাছে ওযু করতে এলে নার্গিস সরে পড়ে সেখান থেকে।
ইসলাম কবুল করবার আগে যে বড়ো খিমায় গাঁয়ের লোকেরা নাচ-গানে কাটাতে অবসর সময়, এখন সেখানেই হচ্ছে নামায। নয়ীম ওযু করে খিমায় ঢুকলেন। গায়ের লোকদের নামায পড়ালেন এবং দোয়া শেষ করে তাদেরকে জানালেন চলে যাবার ইরাদা।
নয়ীম হুমানকে সাথে নিয়ে বাইরে এলেন। বাড়িতে পৌঁছে নয়ীম গেলেন তার কামরায়। হুমান নয়ীমের সাথে ঢুকতে গিয়ে পেছনে গাঁয়ের লোকদের আসতে দেখে ফিরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকালো।
সত্যি সত্যি উনি চলে যাচ্ছে তা হলে? এক বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো।
‘হ্যাঁ, উনি থাকবেন না বলে আমার আফসোস হচ্ছে’। হুমান বললো।
‘আমরা অনুরোধ করলেও থাকবেনা না?’