কয়েকদিনে মধ্যে বস্তির আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেলো। মনোমুগ্ধকর শ্যামল চারণভূমি মুখর হয়ে উঠেলো নয়ীমের ধ্বনিতে। নাচ গানের বদলে চালু হলো পাঁচ ওয়াক্তের নামায।
নয়ীম এবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তিনি কয়েকবার ফিরে যাবার ইরাদা করছেন, কিন্তু বরফপাতের দরুণ পাহাড়ীপথ বন্ধ থাকায় আরও কিছুকাল দেরী না করে উপায় ছিলো না।
নয়ীম বেকার বসে দিন কাটাতে অভ্যস্ত নন। তাই তিনি কখনও বস্তির লোকদের সাথে যান শিকার করতে। একদিন ভালুক শিকারে নয়ীম দিলেন অসাধারণ সাহসের পরিচয়। এক ভালুক শিকারীর তীরে যখমী হয়ে এমন হিংস্র হামলা শুরু করলো যে, শিকারীরা এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। তারা নিজ নিজ জান বাঁচাবার জন্য বড়ো বড়ো পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে তীর ছুঁড়তে লাগলো ভালুকের দিকে। নয়ীম নেহায়েত স্বস্তির সাথে দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের জায়গায়। ক্রুদ্ধ ভালুক তাঁর উপর হামলা করতে এগিয়ে এলো। নয়ীম বাম হাতে ঢাল তুলে আত্মরক্ষা করলেন এবং ডান হাতের নেযাহ্ ঢুকিয়ে দিলেন তার পেটে। ভালুক উল্টে পড়ে গেলো, কিন্তু পরক্ষণেই তীব্র চীৎকার করে উঠে হামলা করলো নয়ীমের উপর। ইতিমধ্যে তিনি তলোয়ার কোষমুক্ত করে হাতে নিয়েছেন। ভালুক থাবা মারবার আগেই নয়ীমের তলোয়ার গিয়ে লাগলো তার মাথায়। ভালুক পড়ে গিয়ে তড়পাতে তড়পাতে ঠান্ডা হয়ে গেলো।
শিকারীরা তাদের আশ্রয়স্থান থেকে বেড়িয়ে এসে হয়রাণ হয়ে তাকাতে লাগলো নয়ীমের দিকে। এক শিকারী বললো, “আজ পর্যন্ত এত বড়ো ভালুক আর কেউ মারতে পারেনি। আপনার জায়গায় আজ আমাদের মধ্যে কেউ থাকলে তার ভালো হতো না। আজ পর্যন্ত কতো ভালুক আপনি মেরেছেন।’
আজই প্রথমবার। নয়ীম তলোয়ার কোষবদ্ধ করতে করতে বললেন।
প্রথমবার? সে হয়রাণ হয়ে বললো, আপনাকে তো নিপুণ শিকারী বলেই মনে হচ্ছে।’
তার জওয়াবে বৃদ্ধ শিকারী বললো, দীলের বাহাদুরী, বায়ুর হিম্মৎ আর তলোয়ারের তেজ যেখানে রয়েছে, সেখানে অভিজ্ঞার প্রয়োজন নেই।
*
গাঁয়ের লোকদের কাছে নয়ীম হয়ে উঠলেন মানবতার সর্বোচ্চ আর্দশ এবং তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ হলো তাদের কাছে অনুকরণীয়। এ বস্তিতে এসে তাঁর দেড়মাস কেটে গেছে। তার একিন রয়েছে যে, কুতায়বা বসন্ত কালের আগে হামলা করতে এগিয়ে আসবেন না। তাই প্রকাশ্যে তার সেখানে আরও কিছু কাল থাকায় কোনো বাঁধা ছিলো না, কিন্তু এক অনুভূতি নয়ীমকে অনেক খানি অশান্ত চঞ্চল করে তুললো।
নার্গিসের চাল-চলন তাঁর শান্ত-সমাহিত অন্তরে আবার তুললো এক ঝড়। ধারণার দিক দিয়ে তিনি প্রথম যৌবনের রঙিন স্বপ্ন সম্পর্কে নির্বিকার হয়ে গেছেন, কিন্তু প্রকৃতির বর্ণগন্ধময় রূপের প্রভাব আর একবার তার মনে জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে সেই ঘুমন্ত অনুভূতিকে।
বস্তির লোকদের মধ্যে নার্গিস রূপ,গুন,আকৃতি,স্বভাব ও চালচলনের দিক দিয়ে অনেকটা স্বতন্ত্র হয়ে দেখা দিয়েছে তার চোখে। গোড়ার দিকে বস্তির লোকেরা যখন নয়ীমকে ভালো করে জানতো না, তখন নার্গিস অসংকোচে তাঁর সামনে এসেছে। কিন্তু বস্তির লোকেরা যখন তাঁর সাথে অসংকোচে মেলামেশা করতে লাগলো, তখন নার্গিসের অসংকোচ সংকোচে রূপান্তরিত হলো। আকাংক্ষার চরম আকর্ষণ তাকে নিয়ে যায় নয়ীমের কামরায়, কিন্তু চরম সংকোচ-শরম তাকে সেখানে দাঁড়াতে দেয় না। নয়ীমকে অচঞ্চল দষ্টিতে সে দেখবে সারাদিন, মনে করে সে যায় তাঁর কামরায় কিন্তু নয়ীমের সামনে গেলেই তার সব ধারণা ভুল হয়ে যায় অন্তরের আশা আকাংক্ষার কেন্দ্র মানুষটির দিকে তাকালেই তার দৃষ্টি অবনত হয়ে পড়ে এবং কম্পিত দীলের সকল আবেদন, অনুনয় ও প্রেরণা সত্ত্বেও আর একবার নযর তুলবার সাহস সঞ্চয় করতে পরে না সে কিছুতেই। যদি বা কখনো সে সাহস যোগায়, তথাপি নয়ীম ও তার মাঝখানে এসে দাঁড়ায় হায়া-শরমের দুর্ভেদ্য নেকাব। এমনি আবস্থায় নয়ীম তাকে দেখছেন ভেবে সে হয়তো আশ্বাস পায়, কিন্তু যখন সে ভূল করে এক আধবার তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তখন দেখে যে, তিনি গদীন নীচু করে পুস্তিনের পশমের উপর হাত বুলাচ্ছেন অথবা হাত দিয়ে একটির পর একটি শুকনো ঘাস ছিঁড়ছেন। এসব দেখে শুনে তার অন্তরের ধুমায়িত অগ্নিশিখা নিভে আসে, তার শিরা-উপশিরায় বয়ে যায় হিমশীতল রক্তপ্রবাহ। তার কানে গুঞ্জরিত সংগীত-ঝংকার নির্বাক হয়ে আসে, তার চিন্তার সূত্র যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে। দীলের মধ্যে এক অসহনীয় বোঝা নিয়ে সে উঠে নয়ীমের দিকে হতাশ দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে যায় কামরা থেকে।
গোড়ার দিকে যেখানে এক নিষ্পাপ যুবতীর মুহব্বত একটি মানুষের অন্তরে আকাংক্ষার তুফান আর ধারণা-কল্পনা ঝড় পয়দা করে দেয়, সেখানেই কতকগুলো অসাধারণ চিন্তা তাঁকে কর্ম ও সংগ্রামের সাহস থেকে করে বঞ্চিত।
নয়ীম হয়ে উঠেছেন নার্গিসের ধারণা, আকাংক্ষা ও স্বপ্নে ছোট্ট দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। তার অন্তর আনন্দে উছল। কিন্তু ভবিষ্যতের চিন্তা করতে গেলেই সংখ্যাতীত আশংকা তাকে করে তোলে পেরেশান। সে তাঁর সামনে না গিয়ে চুপি চুপি তাঁকে দেখে। কখনো এক কাল্পনিক সুখের চিন্তা তার দীলকে করে দেয় আনন্দোজ্জ্বল, আবার এক কাল্পনিক বিপদের আশংকা তাকে প্রহরের পর প্রহর করে রাখে অশান্ত-চঞ্চল।