চলুন, ওখানে নিয়ে যাব আপনাকে। ওরা আপনাকে দেখলে খুবই খুশী হবে। আপনি জানেন, ওরা আপনাকে শাহযাদা মনে করে?
শাহযাদা?’ নয়ীম হাসিমুখে বললেন, ‘ভাই, আমাদের ভেতরে না আছে কোনও বাদশাহ না আছে শাহযাদা।’
‘আমার কাছে আপনি গোপন করছেন কেন?
‘গোপন করে আমার লাভ?’
তা হলে আপনি কে?
এক মুসলামন।’
হয়তো আপনারা যাকে মুসলমান বলেন, আমরা তাকে বলি শাহযাদা।
গানের আওয়ায় ক্রমাগত জোরদার হতে লাগলো। হুমান শুনলো নিবিষ্টমনে। চলুন। হুমান আর একবার বললো, গায়ের লোক আমায় কতোবার অনুরোধ করেছে আপনাকে ওদের মজলিসে নিয়ে যেতে, কিন্তু আমি আপনার উপর যবরদস্তি করতে সাহস করিনি।’
‘আচ্ছা চলো।’ নয়ীম উঠতে উঠতে জওয়াব দিলেন।
কয়েকটি লোক সানাই আর ঢোল বাজাচ্ছে। এক বুড়ো তাতারী গাইছে গান। নয়ীম ও হুমান খিমায় ঢুকতেই সব শান্ত-নিশ্চুপ।
‘তোমরা চুপ করলে কেন?’ হুমান বললো, “গাও।
আবার গান শুরু হলো।
এক ব্যক্তি একটা পুস্তিন বিছিয়ে দিয়ে নয়ীমকে অনুরোধ করলো বসতে। নয়ীম খানিকটা ইতস্ততঃ করে বসলেন। যন্ত্রীরা যখন সঙ্গীতের সুরের সাথে সাথে তাল বদল করলো, অমনি তামাম পুরুষ ও নারী উঠে একে অপরের হাত ধরে শুরু করলো নৃত্য। হুমানও উঠে যমররুদের হাত ধরে শরীক হলো নৃত্যে।
তামাম নৰ্তক-নর্তকীর দৃষ্টি নয়ীমের দিকে নিবন্ধ। নার্গিস তখনো একা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে নয়ীমের দিকে। এক বৃদ্ধ মেষ পালক সাহস করে নয়ীমের কাছে এসে বললো, আপনিও উঠুন। আপনার সাথী ইনতেফর করছে আপনার।
নয়ীম নার্গিসের দিকে তাকালেন। অমনি নার্গিস দৃষ্টি অবনত করলো। নয়ীম নীরবে আসন ছেড়ে উঠে খিমার বাইরে গেলেন। নয়ীম বেরিয়ে যাওয়া মাত্র খিমায় ছেয়ে গেলো একটা গভীর নিস্তব্ধতা।
উনি আমাদের নাচ পছন্দ করেন না। আচ্ছা আমি ওকে ঘরে রেখে এখনি ফিরে আসছি।’ এই কথা বলে হুমান খিমা থেকে বেরিয়ে ছুটে গেলো নয়ীমের কাছে।
আপনি খুব ঘাবড়ে গেলেন?’ সে বললো।
‘ওহহো, তুমিও এসে গেলে?
আমি আপনাকে ঘর পর্যন্ত রেখে আসবো?
না যাও। আমি খানিকক্ষণ এদিকে ফিরে ঘরে যাবো।’
হুমান ফিরে চলে গেলে নয়ীম বস্তির এদিক ওদিক ঘুরে থাকার জায়গার কাছে পৌঁছে ঘরের বাইরে এক পাথরের উপর বসে আসমানের সিতারার সাথে ভাব জমালেন। তাঁর দীলের মধ্যে ভেসে আসতে লাগলো নানা রকমের চিন্তা, কি করছি আমি এখানে? এখানে বেশী সময় থাকা ঠিক হবে না। এক হফতার মধ্যে আমি ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারবো। আমি শিগগিরই চলে যাবো এখান থেকে। এ বস্তি মুজাহিদের দুনিয়া থেকে অনেক-অনেক দূর। কিন্তু এ লোকগুলো কতো সাদাসিধা। এদেরকে নেক রাস্তা দেখানো প্রয়োজন।
নয়ীম এমনি করে ভাবছেন আর ভাবছেন, হঠাৎ পিছন থেকে কারুর পদধ্বনি শোনা গেলো, তিনি ফিরে দেখলেন, নার্গিস আসছে। সে কি যেনে চিন্তা করে ধীরে পা ফেলে এলো নয়ীমের কাছে। তারপর ধরা গলায় বললো,
‘আপনি এ ঠান্ডার ভিতরে বাইরে বসে রয়েছেন?
নয়ীম চাঁদের মুগ্ধকর রৌশনীতে তার মুখের দিকে নয়র করলেন। এ যেমন সুন্দর, তেমনি নিষ্পাপ। তিনি বললেন, নার্গিস, তোমার সাথীদের ছেড়ে কেন এলে তুমি?
‘আপনি চলে এলেন। আমি ভাবলাম …..আপনি ……একাই রয়েছেন হয়তো।
এই ভাঙা ভাঙা কথাগুলো নয়ীমের কানে বাজিয়ে গেলো অনন্ত সুরঝংকার। এক লহমার জন্য তিনি নিশ্চল-নিঃসাড় হয়ে চেয়ে রইলেন নার্গিসের দিকে। তারপর অচানক উঠে একটি কথাও না বলে লম্বা লম্বা কদম ফেলে গিয়ে ঢুকলেন তাঁর কামরায়। নার্গিসের কথাগুলো বহু সময় ধরে তার কানের কাছে গুঞ্জর করে ফিরতে লাগলো এবং তিনি শয্যায় আশ্রয় নিয়ে পাশ ফিরতে লাগলেন বারংবার।
তোরে নয়ীম ঘুম থেকে জেগে বাইরে গিয়ে ঝরণার পানিতে ওযু করে কামরায়, ফিরে এসে ফজরের নামায পড়লেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন বেড়াতে ফিরে এসে কামরায় ঢুকতে গিয়ে দেখলেন, বেশীর ভাগ সময়ে তিনি যেখানে নামায পড়েন, হমান সেখানে চোখ বন্ধ করে কেবলার দিকে মুখ করে রুকু ও সিজদার অনুকরণ করছে। নয়ীম নীরবে দরযায় দাঁড়িয়ে তার নির্বিকার অনুকরণ দেখে হাসতে লাগলেন। হুমান যখন নয়ীমের মতো:বসে খানিক্ষণ ঠোঁট নাড়াচাড়া করে ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখলো, তখন তার নযর পড়লো নয়ীমের উপর। সে ঘাবড়ে গিয়ে উঠে এলো এবং তার পেরেশানি সংযত করতে গিয়ে বললো, আমি আপনার নকল করছিলাম। গাঁয়ের অনেক যুবক-যুবতী এমনি করছে। তারা বলে, এমনি করে থাকে, তাদেরকে খুব ভালো লোক মনে হয়। আমি যখন আপনার কামরায় গেলাম, তখন নার্গিসও এমনি করছিলো। আমি…….।
নয়ীম বললেন, হুমান সব কিছুতেই তুমি কেন আমায় নকল করবার চেষ্টা করছো?
‘কেননা আপনি আমাদের চাইতে ভালো, আর আপনার প্রত্যেক কথাই আমাদের চাইতে ভালো।’
‘আচ্ছা বেশ, আজ গাঁয়ের তামাম লোককে এক জায়গায় জমা করো। আমি তাদের কাছে কিছু কথা বললো।
‘ওরা আপনার কথা শুনে খুব খুশী হবে। আমি এখখুনি তাদেরকে একত্র করছি। হুমান দেরী না করে ছুটে চললো।
দুপুরের আগেই তামাম লোক এক জায়গায় জমা হলো। নয়ীম প্রথম দিন খোদাও তাঁর রসূল (সঃ)-এর তারিফ করলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, ‘আগুন পাথর আর সব জিনিসই খোদার সৃষ্টি। এসব সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে সৃষ্ট জিনিসের পুজা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমাদের কওমের অবস্থাও একদিন ছিলো তোমাদের কওমেরই মতো। তারাও পাথরের মূর্তি তৈরী করে তার পুজা করতো। তারপর আমাদের মাঝে পয়দা হলেন খোদার মনোনীত এক রসূল (সঃ)। তিনি আমাদেরকে দেখালেন এক নতুন পথ। নয়ীম রসূলে মাদানী (সঃ)-এর যিন্দেগী কাহিনী শোনালেন তাদেরকে। এমনি করে চললো আরও কয়েকটি বক্তৃতা। বস্তির তামাম লোককে তিনি টেনে আনলেন ইসলামের দিকে। সবার আগে কলেমা পড়লো নার্গিস আর হুমান।