‘আপনি আশ্বস্ত হোন, সাবেরা জওয়াবে বললেন, বাচ্চারা আমার কারুর পেছেনে পড়ে থাকবে না।’
‘খোদা হাফিজ’ বলে আব্দুর রহমান ঘোড়ার রেকাবে পা রাখলেন। তার বিদায়ের পর সাবেরা সিজদায় মাথা রেখে দো’আ করলেন–ওগো যমিন-আসমানের মালিক! ওঁর কদম মযবুত রেখো।
স্বামী-স্ত্রী যখন চেহারা ও চালচলনে একে অপরের কাছে আকর্ষণের পাত্র হয়ে ওঠে, তখন তাদের মধ্যে মুহব্বতের আবেগপূণ সীমায় পৌঁছা কিছু অস্বাভাবিক নয়। সাবেরা ও আব্দুর রহমানের সম্পর্ক ছিলো বেশক দেহ ও মনের সম্পর্কের মতো। বিদায়-বেলায় তাদের সুকোমল স্পর্শকাতর অন্তরের আবেগ সংবরণ করে রাখা কিছুটা বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু কোন্ আযীমুশান মকসাদ হাসিল করবার জন্য এইসব লোক দুনিয়ার সকল লোভলালসাকে, সকল-আশা আকাংখাকে কোরবান করতেন? কোন্ সে মকসাদ.তিনশ তের জন সিপাহীর একটি মুষ্টিমেয় দলকে টেনে আনতো হাজার সিপাহীর মোকাবিলা করতে? কোন্ সে আবেগ মুজাহিদ দলের অন্তরে দরিয়া ও সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বার, উত্তপ্ত অনন্তপ্রসার মরু অতিক্রম করবার আর আকাশচুম্বী পর্বতচুড়ায় পদচিহ্ন এঁকে যাবার শক্তির সঞ্চার করেছিলো?
এক মুজাহিদই দিতে পারে এসব প্রশ্নের জওয়াব।
আব্দুর রহমানের বিদায়ের পর সাত মাস চলে গেছে। একই বন্তির আরো চারজন লোক ছিলো তাঁর সাথী। একদিন আব্দুর রহমানের এক সাথী ফিরে এলো এবং উট থেকে নেমে সারোর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। তাকে দেখে বহুলোক তার আশে পাশে জমা হলো। কেউ কেউ জিগগেস করলো আব্দুর রহমানের কথা, কিন্তু সে কোন জওয়াব না দিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলো সাবেরার বাড়ির ভিতরে।
সাবেরা নামাযের জন্য ওযু করছিলেন। তাকে দেখে তিনি উঠে এলেন। লোকটি এগিয়ে এসে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে গেলো।
সাবেরা তাঁর দীলের কম্পন সংযত করে প্রশ্ন করলেন, উনি আসেননি?
উনি শহীদ হয়ে গেছেন।
শহীদ’! সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে সাবেরার আঁখিকোণ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
লোকটি বললো, ‘শেষ মুহূর্তে যখন তিনি যখমে কাতর, তখন নিজের রক্ত দিয়ে তিনি এ চিঠিখানা লিখে আমার হাতে দিয়েছিলেন।
সাবেরা স্বামীর শেষ চিঠিখানা খুলে পড়লেনঃ সাবেরা, আমার আরযু পুরো হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি যিন্দেগীর শেষ শ্বাস গ্রহণ করছি। আমার কানে এসে লাগছে এক অপূর্ব সুর-ঝংকার। আমার রূহ দেহের কয়েদখানা থেকে আযাদ হয়ে সেই সুরের গভীরতায় হারিয়ে যাবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছে। যখমে ক্লান্ত হয়ে আমি এক অপূর্ব শান্তির স্পর্শ অনুভব করছি। আমার রূহ এক চিরন্তন আনন্দের সমুদ্রে সঞ্চরমাণ। এখনকার আবাস ছেড়ে আমি এমন এক দুনিয়ায় চলে যাচ্ছি, যার প্রতি কণিকা এ দুনিয়ার তামাম রঙের ছটা আপনার কোলে টেনে নিয়েছে।
আমার মৃত্যুতে অশ্রুপাত করো না। আমার লক্ষ্যবস্তু আমি অর্জন করেছি। আমি তোমার কাছ থেকে দুরে চলে যাচ্ছি, মনে করো না। স্থায়ী সৌভাগ্যের এক কেন্দ্রভূমিতে এসে আবার মিলিত হবো। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা নেই, সেখানে বসন্ত ও শরতের তারতম্য নেই। যদিও সে দেশ চাঁদ সিতারার বহু উর্ধে তথাপি মরদে মুজাহিদ সেখনে খুঁজে পায় তার শান্তির নীড়। আব্দুল্লাহ ও নয়ীমকে সেই গন্তব্য দেশের পথের সন্ধান দেওয়া তোমার ফরয। আমি তোমায় অনেক কিছুই লিখতাম, কি আমার রূহ দেহের কয়েদখানা থেকে আযাদ হবার জন্য বেকারার। প্রভুর পদপ্রান্তে পৌঁছবার জন্য অন্তর আমার অধীর। আমি তোমায় আমার তলোয়ার পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাচ্চাদের এর কদর ও কীমৎ বুঝিয়ে দিও। আমার কাছে তুমি যেমন ছিলে এক কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী, আমার বাচ্চাদের কাছে তুমি হবে তেমনি কর্তব্যনিষ্ঠ মা। মাতৃস্নেহ যেনো তোমার উচ্চাকাংখার পথে প্রতিবন্ধক না হয়। তাদেরকে বলবে মুজাহিদের মৃত্যুর সামনে দুনিয়ার যিন্দেগী অবাস্তব-অর্থহীন।
তোমার স্বামী।
দুই
আব্দুর রহমান শহীদ হবার পর তিন বছর কেটে গেছে। একদিন সাবেরা তাঁর ঘরে সামনে আঙিনায় এক খেজুর গাছের তলায় বসে আব্দুল্লাহকে সবক পড়াচ্ছিলেন। নয়ীম একটা কাঠের ঘোড়া তৈরী করে তাকে ছড়ি নিয়ে এদিক ওদিক তাগিয়ে বেড়াচ্ছিলো। হঠাৎ বাইরে থেকে কে যেন ঘা মারলো তাদের দরযায়। আব্দুল্লাহ জলদী উঠে দরযা খুলে মামুজান বলে আগন্তুকের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কে? সাঈদ? সাবেরা ভিতর থেকে আওয়ায দিলেন।
সাঈদ একটি ছোট বালিকার হাত ধরে আঙিনায় প্রবেশ করলেন। সাবেরা ছোট ভাইকে সাদর আহ্বান জানিয়ে মেয়েটিকে আদর করে প্রশ্ন করলেন, এ উযরা তো নয়! এর চেহারা সুরত তো বিলকুল ইয়াসমিনেরই মতো।
হাঁ বোন, এ উয়রা। আমি ওকে আপনার কাছে রেখে যেতে এসেছি। আমার ফারেস যাবার হুকুম হয়েছে। সেখানে খারেজীরা বিদ্রোহ ছড়াবার চেষ্টা করেছে। আমি সেখানে পৌঁছে যেতে চাই খুব শিগগীর। আগে ভেবেছিলাম, উযরাকে আর কারুর সাথে পাঠিয়ে দেবো আপনার কাছে, পরে নিজেই এখান হয়ে যাওয়া ভালো মনে করলাম।
এখান থেকে কখন রওয়ানা হবার ইরাদা করেছো? সাবেরা প্রশ্ন করলেন।
আজ চলে গেলেই ভালো হয়। আজ আমাদের ফউজ বসরায় থাকবে, কাল ভোরে আমরা ওখান থেকে ফারেসের পথে রওয়ানা হবে।
আব্দুল্লাহ্ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো। নয়ীম এতক্ষণ কাঠের ঘোড়া নিয়ে খেলছিলো, এবার সেও এসে দাঁড়ালো আব্দুল্লাহ পাশে। সাঈদ নয়ীমকে টেনে নিলেন কোলের মধ্যে। তাকে আদর করে আবার তিনি বোনের সাথে আলাপ করতে লাগলেন। নয়ীম আবার খেলাধুলায় ব্যস্ত হলো, কিন্তু খানিকক্ষণ পর কিছু চিন্তা করে সে আব্দুল্লাহর কাছে এলো এবং উযরার দিকে ভালো করে তাকাতে লাগলো। কি যেনো বলতে চাচ্ছিলো সে, কিন্তু লজ্জা তাকে বাধা দিচ্ছিলো। খানিক্ষণ পর সে সাহস করে উযরাকে বললো, তুমিও ঘোড়া নেবে?