ভোরের আলোয় খুলে চোখ তিনি দেখলেন, নার্গিস আবার দুধের পিয়ালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শিয়রে, আর হুমান তাঁকে জাগাচ্ছে ঘুম থেকে।
নার্গিসের পিছনে দাঁড়িয়ে বস্তির আর একটি তরুণী তার দিকে তাকাচ্ছে একাগ্র দৃষ্টিতে। নার্গিস বলনো, বস, যমররুদ! অমনি সে নীরবে বসে পড়লো এক পাশে।
এক হফতা পরে নয়ীমের চলা-ফেরার শক্তি ফিরে এল। তিনি বস্তির নিদোষ আবহাওয়া উপভোগ করতে শুরু করলেন। ভেড়া-বকরী চরিয়ে দিন গুযরান করে বস্তির লোকেরা। আশেপাশে সুন্দর শ্যামল চারণভূমি, তাই তাদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। কোথাও কোথাও সেব ও আঙ্গুরের বাগিচা। ভেড়া-বকরী পালন ছাড়া সেকানকার লোক আনন্দ পায় জংলী জানোয়ার শিকার করে। বস্তির লোকেরা শিকার করতে চলে যায় দূরের বরফ ঢাকা এলাকায়, আর ভেড়া চরিয়ে বেড়ায় বিশেষ করে বস্তির যুবতী মেয়েরা। দেশের রাজনীতির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না এরা। তাতারীদের বিদ্রোহের সমর্থন বা বিরোধিতা-কোনোটারই ধার ধারে না এরা। রাতের বেলা বস্তির যুবক-যুবতীরা এসে জমা হয় মস্ত বড়ড়া খিমায়, সেখানে তারা গান গায় আর নাচে। রাত্রির একভাগ কেটে গেলে মেয়েরা চলে যায় নিজ নিজ ঘরে, আর পুরুষরা অনেক রাত জেগে ছোট্ট ছোট্ট দলে ভাগ হয়ে কাটায় গুল্পগুজবে। কেউ শুনায় আগেরকার দিনের বাদশাহদের কাহিনী, কেউ বলে তার নিজের ভালুক, শিকারের মুগ্ধকর ঘটনা, আর কেউ বসে যায়, জিন, ভুত-প্রেমের অসংখ্য মনগড়া কিস্সা নিয়ে। এরা অনেকটা কুসংস্কার পরস্ত, তাই মন দিয়ে শোনে ভুতের কিস্সা। কিছুদিন ধরে তাদের কাহিনীর বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন এক শাহযাদা। কেউ বলে তার চেহারা ও রূপের কথা, কেউ তারিফ করে তাঁর লেবাসের, কেউ তার যখমী হয়ে বস্তিতে আসায় প্রকাশ করে হয়রাণী, আবার কেউ কেউ বলে, রাখালদের বস্তিতে দেবতারা পাঠিয়েছে এক বাদশাহকে, আর হুমানকে তিনি বানাবেন তার উযির। সোজা কথায়, বস্তির লোকেরা নয়ীমের নাম না নিয়ে তাকে বলতে শাহযাদা।
ওদিকে বস্তির মেয়েদের মধ্যে জল্পনা চললো যে, নবাগত শাহযাদা নার্গিসকে বানাবেন তার বেগম। নার্গিসের সৌভাগ্যে গায়ের মেয়েরা ঈর্ষান্বিতা। শাহযাদা নিরুপায় হয়ে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে কেউ তাঁকে জানায় মোবারকবাদ, আবার কেউ কথায় কথায় তাকে করে বিদ্রূপ। নার্গিস প্রকাশ্যে রাগ করে, কিন্তু সখীদের মুখে এই ধরনের কথা শুনলে তার দীলে জাগে কম্পন। তার সফেদ গায়ের উপর খেলে যায় রক্তিম আভা,। পল্লীর লোকদের মুখ দিয়ে নয়ীমের নতুন নতুন তারিফের কথা শুনবার জন্য তার কানে হয়ে থাকে বেকারার।
নয়ীম এর সব কিছু সম্পর্কে বে-খবর অবস্থায় হুমানদের বাড়ির এক কামরায় কাটিয়ে দিচ্ছে তার যিন্দেগীর নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ দিনগুলো। গাঁয়ের পুরুষ ও মেয়েরা হররোয এসে দেখে যায় তাকে। তার শুশ্রূষার জন্য নয়ীম তাদেরকে জানান অকুণ্ঠ শোকরিয়া। সবাই তাঁকে শাহযাদা মনে করে আদরের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে এবং তাঁর অবস্থা জানাবার জন্য বড় বেশী প্রশ্ন করে না, কিন্তু নয়ীম শান্ত স্বভাব তাদের সব কুষ্ঠ কাটিয়ে দেয় সহজেই। তাই কয়েকদিনের মধ্যেই আদব ও শ্রদ্ধা ছাড়া নয়ীমকে তারা মহব্বতের পাত্র করে নেয়।
*
একদিন সন্ধ্যাবেলায় নয়ীম নামায পড়ছেন। নার্গিস তার সখীদের সাথে ঘরের দর্যয় দাঁড়িয়ে একাগ্রচিত্তে দেখছে তার কার্যকালাপ।
উনি কি করছেন?’ এক কিশোরী হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলো।
উনি যে শাহযাদা।’ যমররুদ শিশুর মতো জবাব দিলো, “দেখ, কি চমৎকার উঠা বসা করছেন! ….ভাগ্য নার্গিসের, তুমিও অমনি করে থাক, নার্গিস?,
‘চুপ। নার্গিস ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বললো।
নয়ীম নামায শেষ করে দো’আর জন্য হাত বাড়ালেন। তরুণীরা দরযার খানিকটা দূরে সরে কথা বলতে লাগলো।
‘চল, নার্গিস! যমররুদ বললো, ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।
‘আমি তোমাদের আগেই বলেছি, ওঁকে এখানে একা ফেলে যেতে পারবো না আমি।’
‘চলো ওকেও সাথে নিয়ে যাবো।’
‘তোমার মাথা বিগড়ে গেছে, কমবখৃত? উনি শাহযাদা না খেলনা? আর এক বালিকা বললো।
মেয়েরা যখন এমনি করে কথা বলছে, তখন হুমানকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখা গেলো। সে নেমে এলে নার্গিস এগিয়ে ঘোড়ার বাগ ধরলো• হুমান সোজা গিয়ে নয়ীমের কামরায় প্রবেশ করলো।
যমররুদ বললো, চল নার্গিস! এবার তোমার ভাই-ই তো ওঁর কাছে বসবে।
‘চলো নার্গিস। আর একজন বললো।
‘চল, চল।’ বলতে বলতে মেয়েরা নার্গিসকে ঠেলে নিয়ে গেলো একদিকে। হুমান ভিতরে প্রবেশ করলে নয়ীম প্রশ্ন করলেন, বল ভাই, কি খবর নিয়ে এলে?
আমি সবগুলো জায়গা ঘুরে দেখে এসেছি। আপনার ফউজের কোন খবর মিললো না। ইবনে সাদেক যেনো গা ঢাকা দিয়েছে। একটি লোকের কাছ থেকে জানলাম, শিগগিরই আপনাদের ফউজ হামলা করবে সমরকন্দের উপর।
হুমান ও নয়ীমের মধ্যে কথাবার্তা চললো অনেকক্ষণ। নয়ীম এশার নামায পড়লেন। আরাম করবেন বলে তিনি শুয়ে পড়লেন। হুমান উঠে আর এক কামরায় চলে যাচ্ছিলো। ইতিমধ্যে গায়ের লোকদের গানের আওয়ায় ভেসে এলো তাদের কানে।
আপনি আমাদের গাঁয়ের লোকদের গান শোনেন নি, কেমন?’ হুমান বললো।
‘আমি এখানে শুয়ে শুয়ে কয়েকবার শুনেছি।’