নয়ীম বেঁহুশ অবস্থার মধ্যে একবার মাথা তুলে দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি এক পাহাড়ী যুবতীর রূপ নিয়ে। দীর্ঘ আকৃতির সাথে দৈহিক স্বাস্থ্য, নিখুঁত অঙ্গপ্রত্যংগ মিলিত হয়ে তার নিষ্পাপ সৌন্দর্যকে যেনো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মোটা অমসৃণ কাপড়ের তৈরী লেবাস তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ম্লান করেনি। সামুরের একটা টুকরা তার গর্দানে জড়ানো। মাথায় টুপি। সুন্দরী তরুনীর মুখ খানিকটা লম্বা এবং তাতে তার মুখখানাকে যেন গম্ভীর করে দিয়েছে। বড় বড় কালো উজ্জ্বল চোখ, নওবাহারের ফুলের চাইতেও মুগ্ধকর পাতলা নাযুক ঠোঁট, প্রশস্ত ললাট ও মযবুত চিবুক-সবকিছু মিলে তাকে করে তুলেছে অপরূপ। নয়ীম এবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন উযরার রূপ, আর একবার দেখলেন জোলায়খার প্রতিচ্ছবি। যুবতী নয়ীমের দেহে রক্তের দাগ দেখে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকার পর সাহস করে কাছে এগিয়ে বললো, আপনি কি যখমী?
নয়ীম তুর্কিস্তানের থেকে তাতারী জবানের যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন। সুন্দরী তরুণীর প্রশ্নে জওযাব না দিয়ে তিনি উঠে বসতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না, মাথা ঘুরে বেঁহুশ হয়ে পড়ে রইলেন।
১০. নয়ীম আবার জ্ঞান ফিরে পেলেন
দশ
নয়ীম আবার জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন তিনি রয়েছেন খোলা ময়দানের পরিবর্তে এক পাথরের ঘরে। তার আশেপাশে কয়েকটি পুরুষ ও নারী। যে সুন্দরী যুবতীর অস্পষ্ট ছবি তখনো নয়ীমের মগজে রয়ে গেছে, সে এক হাতে দুধের পেয়ালা নিয়ে অপর হাত নয়ীমের মাথার নীচে দিয়ে তাকে উপরে তুলবার চেষ্ট করছে। নয়ীম খানিকটা ইতস্তত করে মুখ লাগালেন পিয়ালায়। কিছুটা দুধ পান করার পর তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলে যুবতী তাকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর বিছানার একপাশে সরে বসলো সে। কমযোরীর দরুন নয়ীম কখনো চোখ মুদে থাকেন, আবার কখনো আবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন তরুণী ও আর সবার দিকে। এক নওজোয়ান এসে দাঁড়ালো ঘরের দরযায়। তার এক হাতে নেযাহ, অপর হাতে ধনুক।
তরুণী তার দিকে তাকিয়ে বললো, ভেড়াগুলোকে এনেছ?
হাঁ এনেছি, আর এখই আমি যাচ্ছি।’
‘কোথায়? তরুণী প্রশ্ন করলো।
শিকার খেলতে যাচ্ছি। একটা জায়গায় আমি এক ভালুক দেখে এসেছি। খুব বড়ো ভালুক। উনি এখন আরামে আছেন?’
হাঁ, কিছুটা হুঁশ ফিরেছে।’
যখমের উপর পট্টি বেঁধে দিয়েছো?
না, আমি তোমার জন্য ইনতেহার করছি, ওটা আমি খুলতে পারবো না। তরুণী নয়ীমের বর্মের দিকে ইশারা করলো।
নওজোয়ান এগিয়ে এসে নয়ীমকে কোলের কাছে তুলে নিয়ে তাঁর বর্ম খুলে দিলো। কামিয উপরে তুলে সে তার যখম দেখলো। তার উপর প্রলেপ লাগিয়ে বেঁধে দিয়ে বললো,’ এবার শুয়ে থাকুন। যখম খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু এ প্রলেপে শিগগীরই সেরে যাবে। নয়ীম কিছু না বলে শুয়ে পড়লেন এবং নওজোয়ান চলে গেলো বাইরে। আর সব লোকও একে একে চলে গেলো। নয়ীম তখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন এবং তিনি যে জীবনের সফর শেষ করে জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে গেছেন, সে ধারণাও ধীরে ধীরে মিটে গেছে তার মন থেকে।
‘আমি কোথায়? তরুণীর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন।
‘আপনি এখন আমাদেরই ঘরে।’তরুণী জবাব দিলে, বাইরে আপনি পড়েছিলেন বেহুশ হয়ে। আমি এসে আমার ভাইকে খবর দিয়ে ছিলাম। সে আপনাকে তুলে এনেছে এখানে।’
তুমি কে?’ নয়ীম প্রশ্ন করলেন।
‘আমি ভেড়া চরিয়ে বেড়াই।
‘তোমার নাম কি?
‘আমার নাম নার্গিস।
নার্গিস।
জি হাঁ!’
নয়মের কল্পনায় তারই সাথে সাথে আরো দুটি তরুণীর ছবি ভেসে উঠলো। তার নামের সাথে তার স্বরণ পড়লো আরো দুটি নাম। দীলের মধ্যে উল্লা, জোলায়খা ও নার্গিসের নাম আবৃত্তি করতে করতে তিনি গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলেন ঘরের ছাদের দিকে।
আপনার ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই। তরুণী নয়ীমের মনোযোগ আর্কষণ করে বললো। তারপর উঠে সামনের কামরা থেকে কয়েকটি সেব ও শুকনো মেওয়া এনে রাখলো নয়ীমের সামনে। সে নয়ীমের মাথার নীচের হাত দিয়ে উপরে তুললো এবং ভর দিয়ে উঁচু হয়ে বসবার জন্য একটা পুস্তিকন এনে দিলো তার পেছন দিকে। নয়ীম কয়েকটি সেব খেয়ে নার্গিসকে জিজ্ঞাস করলেন, যে নওযোয়ান এখন এসেছিল, সে কে?
ও আমার ছোট ভাই।’
“কি নাম ওর?’
হুমান। নার্গিস জওয়াব দিলো।
নার্গিসকে আরো কয়েকটি প্রশ্ন করে নয়ীম জানলেন যে তার বাপ-মা আগেই মারা গেছেন। সে তার ভাইয়ের সাথে থাকে এই ছোট্ট বস্তিতে আর হুমান হচ্ছে বস্তির রাখালদের সরদার। বস্তির বাসিন্দাদের সংখ্যা প্রায় ছয়শ।’
সন্ধ্যা বেলায় হুমান ফিরে এসে জানালো যে, তার শিকার মেলেনি।
নার্গিস ও হুমান নয়ীমের শুশ্রূষার কোন কসুর করে না। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকে তারা নয়ীমের শয্যার পাশে। নয়ীমের চোখে যখন নেমে আসে ঘুমের মায়া, নার্গিস তখন উঠে যায় অপর কামরায় আর হুমান তার পাশেই শুয়ে পড়ে ঘাসের বিছানায়। রাতভর নয়ীম দেখতে থাকেন কতো মুগ্ধকর স্বপ্ন। আব্দুল্লাহর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর এই প্রথম রাত স্বপ্নের ঘোরে নয়ীমের কল্পনা জংগের ময়দান ছেড়ে উঠে গেছে আর এক নতুন দেশে। কখনো তিনি দেখছেন যেনো তার মরহুম ওয়ালেদা তার যখমের উপর প্রলেপ লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছেন আর উযরার মুহব্বত ভরা দৃষ্টি তাঁকে দিচ্ছে শান্তির পয়গাম। আবার তিনি দেখছেন, যেনো জোলায়খা তাঁর আলোক-দীপ্ত মুখের আলোয় উজ্জ্বল করে তুলেছেন কয়েদখানার অন্ধকার কুঠরী।