একদিন এক গুপ্তচরের কাছ থেকে নয়ীমের অগ্রগতির খবর পেয়ে সে খুবই ঘাবড়ে গেল।
তার সাথে কত ফউজ রয়েছে? ইবনে সাদেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলো।
মাত্র তিনশ সিপাহী।’ গুপ্তচর জওয়াব দিলো।
কুল্পে তিনশ লোক? এক তাতারী নওজোয়ান অট্টহাস্য করে বললো।
ইবনে সাদেক বললো, তুমি হাসছ কেন? এই তিনশ,ফউজ আমার চোখে চীন ও তুর্কিস্তানের তামাম ফউজের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক।’
তাতারী বললো, আপনি একিন রাখবেন, ওরা এখানে পৌঁছাবার আগেই আমাদের পাথরের তলায় চাপা পড়ে থাকবে।
নয়ীমের কল্পনা ইবনে সাদেকের কাছে মৃত্যুর চাইতেও ভয়ানক। তার কাছে সাতশর বেশী তাতারী মওজুদ রয়েছে, তথাপি তার মনে বিজয়ের একিন নেই। সে জানে, খোলা ময়দানে মুসলমানের মোকাবিলা করা খুবই বিপজ্জনক। সে তামাম পাহাড়ী রাস্তায় পাহাড়া বসিয়ে নয়ীমে ইনতেজার করতে লাগলো।
নয়ীম ইবনে সাদেকের সন্ধান করতে করতে গিয়ে বেরুলেন কোকন্দের উত্তর পূর্ব দিকে। এখানকার অসমতল যমিনের উপর দিয়ে ঘোড়া এগুতে লাগলো অতি কষ্টে। উঁচু পাহাড়-চুড়ায় ঝলমল করছে জামাট বরফপ্প! নীচের উপত্যকাভূমির কোথাও কোথাও ঘন বন। কিন্তু বরফ পাতের মওসুমে বনের গাছ পালা পত্রহীন। নয়ীম এক উঁচু পাহাড়ের পাশের সংকীর্ণ পথ দিয়ে যাচ্ছেন। অমনি আচানক পাহাড়ের উপর থেকে তাতারীরা শুরু করলো তীরবর্ষণ। কয়েকজন সওয়ার যখমী হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো এবং ফউজের মধ্যে দেখা দিল বিশৃংখলা। পাঁচটি ঘোড়া সওয়ার সমেত গিয়ে পড়লো এক গভীর খাদের মধ্যে। নয়ীম সিপাহীদের ঘোড়া থেকে নামবার হুকুম দিয়ে পঞ্চাশ জনকে পাহাড় থেকে খানিকটা দূরে একটা নিরাপদ জায়গায় ঘোড়াগুলো নিয়ে যেতে বললেন এবং বাকী আড়াইশ সিপাহী সাথে নিয়ে তিনি পায়দল এগিয়ে চললেন পাহাড়ের উপর। তখনো যথারীতি পাথরবর্ষণ চলছে। মুসলমানরা মাথার উপর ঢাল ধরে পাহাড়ারে চূড়ায় উঠতে উঠতে নয়ীমের ষাটজন সিপাহী পড়ে গেছে পাথরের আঘাত খেয়ে। নয়ীম তার বাকী লোকদের নিয়ে পাহাড় চূড়ায় মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে হামলা করলেন। মুসলমানদের অসাধারণ ধৈর্য দেখে তাতারীদের উৎসাহে ভাটা পড়লো। তারা চারদিক থেকে সরে এসে একত্র হতে লাগলো। ইবনে সাদেক মাঝখানের দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে হামলা করতে। তা উপর নয়ীমের নযর পড়তেই তিনি জোশের আতিশয্যে আল্লাহু আকবর আওয়ায করে হাতে তলোয়ার আর অপর হাতে নেযাহ নিয়ে পথ সাফ করে এগিয়ে চললেন। তাতারীরা ক্রমাগত ময়দান ছেড়ে পালাতে লাগলো। ইবনে সাদেক তখন প্রাণের ভয়ে অস্থির। সে তার অবশিষ্ট ফউজকে ফেলে পালালো একদিকে। নয়ীমের চোখ তারই দিকে নিবন্ধ। তাকে পালাতে দেখে নয়ীম তার পিছু ধাওয়া করলেন। ইবনে সাদেক পাহাড় থেকে নেবে গেলো নীচে। প্রয়োজনের সময়ে নিজে বাঁচবার বন্দোবস্ত সে আগেই করে রেখেছিলো। পাহাড়ের নীচে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল দুটি ঘোড়া নিয়ে। ইবনে সাদেক ঝট করে এক ঘোড়ায় চেপে ছুটে চললো। তার সাথী কেবলমাত্র রেকাবে পা রেখেছে অমনি নয়ীম নেযাহ মেরে তাকে ফেলে দিল নীচে। তারপর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে চললেন ইবনে সাদেকের পিছু পিছু।
নয়মের ধারণা মোতাবেক ইবনে সাদেক ছিলো শিয়ালের চাইতেও বেশী ধুর্ত। পরাজয় নিশ্চিত দেখলে কি করে নিজের জান বাঁচাতে হবে পুরো ইনতেযাম সে আগেই করে রেখেছে। নয়ীম আর ইবনে সাদেকের মাঝখানে দূরত্ব বড় বেশী নয়। কিন্তু কিছুক্ষণ তার অনুসরণ করার পর নয়ীম বুঝলেন যে, তাদের মাঝখানের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, আর তার ঘোড়াও ইবনে সাদেকের ঘোড়র তুলনায় অপেক্ষকৃত কম চলতে পারে। তবু নয়ীম তার পিছু ছাড়তে পারলেন না এবং তাকে চোখের আড়াল হতে দিলেন না।
ইবনে সাদেক পাহাড়ী পথ ছেড়ে উপত্যকার দিকে চললো। উপত্যকায় মাঝে মাঝে ঘন গাছপালা। এক জায়গায় ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালার নীচে ইবনে সাদেক কয়েকজন সিপাহী দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সে ছুটে পালাতে পালাতে তাদেরকে ইশারা করলো, অমনি তারা গা ঢাকা দিলো গাছের আড়ালে। নয়ীম যখন সেই গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন তখন এক তীর এসে লাগলো তার বায়ুতে, কিন্তু তিনি ঘোড়ার গতিবেগ হ্রাস করলেন না।
খানিকক্ষণ পর আর একটি তীর লাগলো তার পিছন দিকে। তারপর আর একটি তীর এসে ঘোড়ার পিঠে পড়তেই ঘোড়া ছুটে চললো আরও দ্রুতগতিতে। নয়ীম তার বায়ু ও পিছন দিক থেকে তীর টেনে বের করলেন কিন্তু ইবনে সাদেকের পিছু ছাড়লেন না। আর ও কিছুদূর চলবার পর একটি তীর এসে লাগলো নয়ীমের কোমরে। আগেই প্রচুর রক্তপাত হয়েছে তার দেহ থেকে। তৃতীয় তীর লাগবার পর তার দেহের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসতে লাগলো, কিন্তু যতক্ষণ জ্ঞান থাকল, ততক্ষণ মুজাহিদের হিম্মৎ থাকলো অটুট। ততক্ষণ তিনি ঘোড়র গতিবেগ কম হতে দিলেন না। গাছের সারি শেষ হয়ে গেল, এবার দেখা দিল প্রশস্ত ময়দান। ইবনে সাদেক অনেকখানি আগে চলে গেছে, কমযোরী নয়ীমের উপর জয়ী হচ্ছে। তার চোখে নেমে আসছে নিবিড় অন্ধকার। তার মাথা ঘুরছে, কানের ভিতরে শ শ করছে। নিরুপায় হয়ে ঘোড়া থেকে নামতেই তিনি বেহুশ হয়ে পড়লেন যমিনের উপর উপুর হয়ে। বেঁহুশ অবস্থায় তার কয়েক মুহূর্ত কাটলো। যখন কিছুটা হুশ ফিরে এল, তখন তার কানে ভেসে এলো কারুর দূরাগত সংগীতের আওয়াম। বহুদিন এমন মধুর আওয়ায নয়ীমের কানে আসেনি। বহুক্ষণ নয়ীম অজ্ঞানের মত পড়ে শুনলেন সে সুরঝংকার। অবশেষে তিনি হিম্মৎ করে মাথা তুললেন। তার কাছেই চরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি ভেড়া। যে গান গাইছে তাকে দেখতে চান নয়ীম, কিন্তু দুর্বলতার দরুন আবার তার চোখের সামনে নামলো অন্ধকারের পরদা এবং তিনি নিরুপায় হয়ে মাথা রাখলেন যমিনের উপর। একটি ভেড়া নয়ীমের কাছে এলো এবং নয়ীমের কানের কাছে মুখ নিয়ে তার দেহের ঘ্রাণ নিতে লাগলো। তারপর তার নিজের ভাষায় আওয়ায দিয়ে ডাকলো আর একটি ভেড়াকে। দ্বিতীয় ভেড়াটিও তেমনি আওয়াম করে বাকী ভেড়াগুলোকে খবর দিয়ে এগিয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেকগুলো ভেড়া নয়ীমের আশেপাশে জমা হয়ে কোলাহল শুরু করলো। এক তুর্কিস্তানী তরুণী ছড়ি হাতে ভেড়ার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে তাড়িয়ে যথারীতি গান গেয়ে চলেছে। একই জায়গায় এতগুলো ভেড়ার সমাবেশ দেখে সে এগিয়ে এলো। ভেড়াগুলোর মাঝখানে নয়ীমকে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখে সে চীৎকার করে উঠলো। তারপর কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে আঙুল কামড়াতে লাগলো হতবুদ্ধির মতো।