কুতায়বা বললেন, ইরান থেকে যে ফউজ আসবে, তাদের জন্য ইনতেযার করতে হবে আমাদের। তারা পৌঁছ গেলেই আমরা হামলা করবো।’
কুতায়বা ও নয়ীমের আলাপের মধ্যে এক সিপাহী খিমায় এসে বললো, এক তুর্ক সরদার আপনার মোলাকাত প্রার্থী।
তাকে নিয়ে এস।’ কুতায়বা বললেন।
সিপাহী চলে যাবার খানিকক্ষণ পরেই এক বৃদ্ধ সরদার খিমায় দাখিল হলেন। তিনি ছিলেন পুস্তিন ও সামুরের টুপি পরিহিত। তিনি ঝুঁকে পড়ে কুতায়বাকে সালাম করে বললেন, সম্ভবতঃ আপনি আমায় চিনতে পারছেন। আমার নাম নিযক।
‘আমি আপনাকে ভাল করেই চিনি। বসুন।
নিযক কুতায়বার সামনে বসে পড়লেন। কুতায়বা তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন।
নিযক বললেন, আমি আপনাকে বলতে এসেছি, আপনি আমাদের কওমের উপর কঠোর হবেন না।’
কঠোর! কুতায়বা দ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, ‘বিদ্রোহিদের সাথে যে আচরণ করা হয়, তাই করা হবে তাদের সাথে। তারা মুসলিম শিশু ও নারীর রক্তপাত করতেও দ্বিধা করছে না।’
কিন্তু ওরা বিদ্রোহী নয়। নিযক গাম্ভীর্যের সাথে জওয়াব দিলেন, ‘ওরা বেঅকুফ। এ বিদ্রোহের পূর্ণ যিম্মাদারী আপনাদেরই এক মুসলমান ভাইয়ের।
আমাদের ভাই? কে সে?
‘ইবনে সাদেক।’ নিযক জওয়াব দিলেন।
নয়ীম এতক্ষণ মোমবাতি আলোয় বসে নকশা দেখছিলেন। ইবনে সাদেকের নাম শুনে তিনি চমকে উঠলেন। ইবনে সাদেক!’ তিনি নিযকের দিকে তাকিয়ে বললেন।
হাঁ, ইবনে সাদেক।
‘সে লোকটি কে?’ কুতায়বা প্রশ্ন করলেন।
নিযক জওয়াবে বললেন, “সে তুর্কিস্তানে এসেছে দু’বছর আগে এবং তার কথার যাদুতে তুর্কিস্তানের সকল গণ্যমান্য লোককে আপনাদের হুকুমাতের খেলাফ বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করেছে। এর বেশি তার সম্পকে আমি কিছু জানি না।’
‘আমি তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি।’ নয়ীম নকশা ভাঁজ করতে করতে বললেন, “আজকাল কি সে তবে নায়কের সাথে রয়েছে?
না, সে কোকদের কাছে ওজওয়াক নামক স্থানে পাহড়ী লোকদের জমা করে নায়কের জন্য এক ফউজ তৈরী করছে। সম্ভবত সে হুকুমাতে চীনের সাহায্য হাসিল করবারও চেষ্টা করবে।’
নয়ীম কুতায়বার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি বহুদিন ধরে এই লোকটির খুঁজে বেড়াচ্ছি। সে যে আমার এত কাছে, তা আমি জানতাম না। আপনি আমায় এজাযত দিন। ওকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আনা নেহায়েত জরুরী।
কিন্তু লোকটি কে তাওতো জানতে হবে আমায়।
‘সে আবু জেহেলের চাইতে বড় ইসলামের দুশমন, আব্দুল্লাহ বিন উবাইর চাইতে বড় মোনাফেক, সাপের চাইতে বেশী ভয়ানক আর শিয়ালে চাইতেও বেশী ধূর্ত। তার তুর্কিস্তানে থাকায় প্রতি মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ওর দিকে আমাদেরকে অবিলম্বে নজর দিতে হবে।’
কিন্তু এই মওসুমে? কোকেন্দের পথে রয়েছে বরফের পাহাড়।
‘তা যাই থাক, আপনি আমায় এজাযত দিন। নয়ীম বললেন, ‘কোকন্দে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই মনে করে সে ওখানে রয়েছে। সম্ভবতঃ সে শীতের মওসুম ওখানে কাটিয়ে গরমের দিনে আর কোনও নিরাপদ জায়গা খুঁজে নেবে।
কবে যেতে চাও তুমি?’
‘এই মুহূর্তে। নয়ীম জওয়াব দিলেন, আমার একটি মুহূর্ত অপচয় করাও ঠিক হবে না।’
‘এ সময়ে বরফপাত হচ্ছে। ভোরে চরে যাবে। এইমাত্র তুমি এক দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে এলে। খানিকক্ষণ আরাম কর।
যতক্ষণ এ আপদ যিন্দাহ রয়েছে, ততক্ষণ আরামের অবকাশ নেই আমার। এখন একটি মুহূর্তের অপচয় আমি গুনাহ মনে করি। আমায় এজাযত দিন। কথাটি বলেই নয়ীম উঠে দাঁড়ালেন।
‘আচ্ছা দু’শ সিপাহী তোমার সাথে নিয়ে যাও।’
নিযক হয়রান হয়ে বললেন, আপনি এক কোনন্দে পাঠাচ্ছেন মাত্র দুশ সিপাহী সাথে নিয়ে! পাহাড়ী লোকদের লড়াইর তরিকা আপনি জানেন? বাহাদুরীর দিক দিয়ে দুনিয়ার কোন কওমের চাইতে কম নয় তারা। ওর উচিত বেশ বড় রকমের ফউজ নিয়ে যাওয়া। ইবনে সাদেকের কাছে সব সময় মওজুদ থাকে পাঁচশ সশস্ত্র নওজোয়ান। এখন পর্যন্ত কত ফউজ সে একত্র করেছে তাই বা কে জানে?
নয়ীম বললেন, ‘এক বুযদীল সালার তার সিপাহীদের মধ্যে বাহাদুরীর ঐশ্বর্য পয়দা করতে পারে না। যদি সেই ফউজের সালার ইবনে সাদেক হয়ে থাকে তাহলে এত সিপাহীও দরকার হবে না আমার।’
কুতায়বা মুহূর্তকাল চিন্তা করে নয়ীমকে তিনশ সিপাহী সাথে নিয়ে যাবার হুকুম দিলেন। তারপর তাকে কয়েকটি নির্দেশ দিয়ে বিদায় করে দিলেন।
এক মুহূর্ত পর কুতায়বা ও নিযক খিমার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, নয়ীম এক ক্ষুদ্রাকার ফউজ নিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছেন সামনের এক পাহাড়ী পথ।
‘বহুত বাহাদুর ছেলে। নিযক কুতায়বাকে বললেন।
‘হাঁ, ও এক মুজাহিদের বেটা। কুতায়বা জওয়াব দিলেন।
আপনারা কেন এত বাহাদুর, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি? নিক আবার প্রশ্ন করলেন।
কেননা আমরা মওতকে ভয় করি না। মওত আমাদের কাছে নিয়ে আসে এক উষ্ণতর যিন্দেগীর খোশখবর। আল্লার জন্য যিন্দাহ থাকবার আকাংখা ও আল্লারই পথে মৃত্যুবরণ করবার উদ্যম পয়দা করে নেবার পর কোন মানুষেরই মনে অন্যকোনো বড়ো শক্তির ভয় থাকতে পারে না।
‘আপনদের কওমের প্রত্যেক ব্যক্তিই কি এমনি বাহাদুর?
হাঁ, যারা তওহীদ ও রেসালাতের উপর সাচ্চা দীলে ঈমান আনে, তাদের প্রত্যেকেই এমনি।’
*
ইবনে সাদেক কোকন্দের উত্তরে একটি নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়ে দিন যাপন করছে। এক উপত্যকার চারদিকে উঁচু পাহাড় তার জন্য এক অপরাজেয় প্রাচীরের কাজ করছে। পাহাড়ী এলাকার দুর্দান্ত বাসিন্দারা ছোট ছোট দলে এসে জমা হচ্ছে সেই উপত্যকায়। ইবনে সাদেক এই লোকগুলোকে সোজা পথে কাটিয়ে দিচ্ছে নাযযাকের কাছে। তার গুপ্তচর তাকে এনে দেয় মুসলমাদের প্রতিনিধির খবর। মুসলমান শীতের মওসুম শেষ না হলে লড়াই শুরু করবে না। এই ধারণা নিয়ে আশ্বস্ত ছিলো ইবনে সাদেক। তার আরও বিশ্বাস ছিলো যে, প্রথমতঃ অতদূর থেকে মুসলমান তার চক্রান্তের খবর পাবে না। আর যদি খবর পেয়েও যায়, তথাপি শীতের দিনে এদিকে আসতে পারবে না। যদি শীতের পর তারা এ পথে আসেও তাহলে খোদার দুনিয়া বহু দুর বিস্তৃত।