তলোয়ার কোথায় পেলে তুমি?’
‘এই দেখুন আমি!’ নয়ীম তার ছড়িটি দেখিয়ে বললেন, এটা কাঠের তৈরি, কিন্ত আমার একটা লোহার তলোয়ার চাই। এনে দেবেন? আমি জিহাদে যাবো।’
বাচ্চা ছেলের মুখে জিহাদের কথা শোনার খুশী সেই মায়েরাই জানতো, যারা তাদের জিগরের টুকরাকে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে বলতোঃ
ওগো কাবার প্রভু, যাদু আমার-বাছা আমার
হোক বীর মুজাহিদ,
মানবতার বাগিচায় তোমার বন্ধুর লাগানো তরুমূলে
সিঞ্চন করুক যৌবনের রক্তধারা।’
নয়ীমের মুখে তলোয়ার ও হিজাদের কথা শুনে সাবেরার মুখ খুশীর দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তাঁর দেহে মনে জাগলো অপূব আনন্দ-শিহরণ। আনন্দের আবেশে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। অতীত ও বর্তমান মুছে গেলো তার চোখের সামনে থেকে। কল্পনায় তিনি তার নওজোয়ান বেটাকে দেখতে লাগলেন মুজাহিদবেশে খুবসুরত ছোঁড়ায় সওয়ার হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে। তাঁর প্রিয় পুত্র দুশমনের সারি ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে বীর পদভারে। দুশমনের ঘোড়া আর হাতী তার নির্ভীক হামলার সামনে দাঁড়াতে না পেরে আগে আগে সরে যাচ্ছে। তাঁর নওজোয়ান বেটা তাদের অনুসরণ করে ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গর্জন মুখর দরিয়ার বুকে। বরাবর সে এসে যাচ্ছে দুশমনের নাগালের ভিতরে। তারপর শেষ পর্যন্ত আঘাতে আঘাতে ক্লান্ত হয়ে কলেমায়ে শাহাদৎ পড়ে নির্বাক হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে ভাসছে, যেনো জান্নাতের হুরদল শারাবন তার জাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতীক্ষায়। সাবেরা ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন’ পড়ে সিজদায় মাথা নত করে দো’আ করলেনঃ
‘ওগো যমিন-আসমানের মালিক! মুজাহিদের মায়েরা যখন হাযির হবেন তোমার দরবারে, তখন আমি যেনো কারুর পেছনে না থাকি। এই বাচ্চদেরকে তুমি এমন যোগ্যতা দান করো, যেনো তারা পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ঐতিহ্য কায়েম রাখতে পারে।’
দোআ শেষ করে সাবেরা উঠে দুই পুত্রকে কোলে টেনে নিলেন।
মানবজীবনে এমন হাজারো ঘটনা ঘটে, যা বুদ্ধির সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র ছাড়িয়ে দীলের রাজ্যের অন্তহীন প্রসারের সাথে সম্পর্ক খুঁজে বেড়ায়। দুনিয়ার যে কোনো ঘটনাকে যদি আমরা বুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করি, তাহলে কতো মামুলী ঘটনাও আমাদের কাছে রহস্যময় হয়ে দেখা দেয়। অনুভূতি ও আবেগকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি নিজস্ব অনুভূতি ও আবেগ দিয়ে। তাই তাদের যেসব কার্যকলাপ আমাদের মানসিক আবেগ থেকে উচ্চ পর্যায়ের মনে হয়, তা আমাদের চোখে বিসদৃশ লাগে। আজকালকার মায়েদের কাছে প্রাচীন যুগের বাহাদুর মায়ের আশা-আকাংখা কতো বিস্ময়কর প্রতীয়মান হয়। আপনার জিগরের টুকরাকে আগুন ও খুনের ভিতরে খেলতে দেখার আকাংখা তাদের চোখে কত ভয়ানক। আপন বাচ্চাকে বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায় যে মায়েরা, সিংহের মোকাবিলা করবার স্বপ্ন তারা কি করে দেখবে।
আমাদের কলেজ, হোটেল আর কফিখানার পরিবেশে পালিত হয় যে সব নওজোয়ান, তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি কি করে জানবে পাহাড়ের উচ্চতা ও সমুদ্রের গভীরতা লংঘনকারী মুজাহিদদের দীলের রহস্য? বরাবের সুর-মুৰ্ছনার সাথে সাথে ঝিমিয়ে পড়ে যেসব নাযুক মেযাজ মানুষ, তীর ও নেয়ার মোকাবিলায় এগিয়ে যাওয়া জোয়ানদের কাহিনী তাদের কাছে কতো বিস্ময়কর! নীড়ের আশেপাশে উড়ে বেড়ায় যেসব পাখী, কি করে পরিচিত হবে তারা আকাশচারী ঈগলের উড়ে বেড়ানো সাথে!
*
সাবেরার শৈশব যৌবনের যিন্দেগী কেটেছে এক অতি সাধারণ পরিবেশের ভিতর দিয়ে। তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে আরবের সেই শাহসওয়ারদের খুন, যাঁরা কুফর ও ইসলামের গোড়ার দিকের লড়াইয়ে দেখিয়েছেন তাদের তলোয়ারের শক্তি। তাঁর দাদা ইয়ারমুকের লড়াই থেকে এসেছিলেন গাজী হয়ে, তারপর শহীদ হয়েছিলেন কাদসিয়ার ময়দানে। ছোটবেলা থেকেই গাজী ও শহীদ শব্দগুলো তাঁর কাছে পরিচিত। আধো আধো বুলি দিয়ে তিনি যখন হরফ উচ্চারণ করবার চেষ্টা করতেন, তখন তার মা তাকে প্রথমে শিখিয়েছেন ‘আব্বা গাজী”,তারপর আরো কিছুকাল পরে শিখিয়েছেন ‘আব্বা শহীদ। এমনি এক পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলেই যৌবনে ও বার্ধক্যে তাঁর কাছ থেকে আশা করা যেতো-এক কর্তব্যনিষ্ঠ মুসলিম নারীর গুণরাজি। ছোট বেলায় তিনি শুনেছেন কতো আরব নারীর শৌর্যের কাহিনী। বিশ বছর বয়সে তার শাদী হয়েছিলো আব্দুর রহমানের সাথে নওজোয়ান স্বামী ছিলেন মুজাহিদের যাবতীয় গুণে গুণান্বিত। বিশ্বস্ত বিবির মুহব্বত তাঁকে ঘরের চার দেওয়ালের ভিতর বেঁধে রাখেনি, হামেশা তাঁকে দিয়েছে জিহাদের অনুপ্রেরণা।
আব্দুর রহমান যখন শেষ বারের মতো জিহাদের ময়দানে রওয়ানা হলেন, আব্দুল্লাহ তখন তিন বছরের শিশু, আর নয়ীমের বয়স তিন মাসেরও কম। আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহকে তুলে বুকে চেপে ধরলেন, তারপর নয়ীমকে সাবেরার কোল থেকে নিয়ে আদর করলেন। মুখের উপর বিষণ্ণতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। কিন্তু তখুনি তিনি হাসি টেনে আনবার চেষ্টা করলেন। জীবনসাথীকে লড়াইয়ের ময়দানে যেতে দেখে খানিকক্ষণের জন্য সাবেরার দীলের মধ্যে ঝড় বইতে লাগলো, কিন্তু কষ্টে তিনি চোখের কোনে উছলে-ওঠা অশ্রুধারা সংযত করে রাখলেন।
আব্দুর রহমান বলে উঠলেন, সাবেরা! আমার কাছে ওয়াদা করো, যদি আমি লড়াইয়ের ময়দান থেকে ফিরে না আসি, তাহলে যেনো আমার পুত্রেরা আমার তলোয়ারে জং ধরতে না দেয়।