মরণজয়ী’ সহ নসীম হিজাযীর বিভিন্ন উপন্যাস এবং অন্যান্য বহু গ্রন্থ উর্দু ও ফারসী থেকে বাংলায় অনুবাদের গৌরব যার প্রাপ্য, বাংলা সাহিত্যের সেই নীরব সাধক সৈয়দ আবদুল মান্নান বহুদিন হল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন জীবন সাগরের পরপারে। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
ইসলামের ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করে মরণজয়ী’ রচিত, আলমে ইসলামের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তার অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। এ সত্যটি যদি পাঠকেরা উপলব্ধি করতে পারেন, তবেই আমাদের এ প্রয়াস সার্থক হবে।
সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।
আবদুল গফুর
.
ইসলামী বিধান কায়েম করার সগ্রামে জীবন কুরবান মুজাহিদীনের উদ্দেশ্যে–আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, যদিও তোমরা তা অনুভব করো না। –আল-কোরআন, সূরা ২: ১৫৪
এক
সূর্য কতোবার পূর্ব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত গিয়েছে। চাঁদ তার মাসিক সফর শেষ করেছে হাজারো বার। সিতারার দল লাখো বার রাতের অন্ধকারে দীপ্তি ছড়িয়ে ভোরের আলোয় আত্মগোপন করেছে। মানব-বাগিচায় বারংবার এসেছে বসন্ত, আবার এসেছে শরৎ। জান্নাত থেকে নির্বাসিত মানবতার নতুন বাসভূমি হয়েছে এমন এক সগ্রামক্ষেত্রে, যেখানে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান রয়েছে অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত। দুনিয়ায় এসেছে বিপ্লবের বিভিন্ন রূপ। তাহযিব ও তমদুনের হয়েছে নব রূপায়ন। হাজার হাজার কওম অধোগতির নিম্নতম স্তর থেকে উঠে এসে ঝড় ও ঘূর্ণিবায়ুর মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ার বুকে, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে উত্থান পতনের সম্পর্ক এমনি মযবুত যে, তারা কেউ এখানে চিরস্থায়ী হয়ে থাকেনি। যে সব কওম তলোয়ারের ছায়ায় বিজয়-ডংকা বাজিয়ে জেগে উঠেছিলো, তারাই আবার বাদ্য গীতের সুর মুছনায় বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। উপরে নীল আসমানকে প্রশ্ন করঃ তার অন্তহীন বিস্তৃত বুকের উপর আঁকা রয়েছে অতীতের কতো যুগযুগান্তরের হাজারো কাহিনী; কতো কওমের উত্থান-পতন সে দেখেছে; সে দেখেছে কতো শক্তিমান বাদশাহকে তাজ ও তখৃত হারিয়ে ফকীরের লেবাস পরতে, দেখেছে কতো ফকীরকে শাহী তাজ পরিধান করতে। হয়তো বারংবার একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি দেখে সে হয়ে আছে নির্বিকার-উদাসীন। কিন্তু আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, আরবের মরুচারী যাযাবরদের উত্থান ও পতনের দীর্ঘ কাহিনী আজো তার মনে পড়ে। সে কাহিনী আজকের এ যুগ থেকে কতো স্বতন্ত্র! যদিও কাহিনীর কোনো অংশই কম চিত্তাকর্ষক নয়, তথাপি আমাদের সামনে রয়েছে আজ তার এমন এক উজ্জ্বল, অধ্যায়, যখন পূর্ব-পশ্চিমের উপত্যকাভূমি, পাহাড় ও মরু-প্রান্তর মুসলমানদের বিজয় অশ্বের পদধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে, তাদের প্রস্তর বিদীর্ণকারী তলোয়ারের সামনে ইরান ও রুমের সুলতানের মস্তক হয়েছে অবনমিত। এ ছিলো সেই যুগ, যখন তুর্কীস্থান,আন্দালুস ও হিন্দুস্থান মুসলমানদের আহবান জানিয়েছে তাদের বিজয় শক্তির পরীক্ষার জন্য।
বসরার প্রায় বিশ মাইল দূরে একটি উর্বর সবুজে ঢাকা বাগিচার মাঝখানে একটি ছোট্ট বস্তি। তারই একটি সাদাসিধা বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মধ্য বয়স্কা নারী সাবেরা আসরের নামায পড়ছেন। আর একদিকে তিনটি বালক-বালিকা খেলাধুলায় ব্যস্ত। দুটি বালক আর একটি বালিকা। বালক দুটির হাতে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের ছড়ি। বালিকা নিবিষ্ট মনে দেখছে তাদের কার্যকলাপ। বড় ছেলেটি ছড়ি ঘুরিয়ে ছোট ছেলেটিকে বলছে, দেখো নয়ীম, আমার তলোয়ার!, ছোট ছেলেটি তার ছড়ি দেখিয়ে বললো, আমারো আছে তলোয়ার। এসো, আমরা লড়াই করি।
ণা, তুমি কেঁদে ফেল্বে। বড় ছেলেটি বললো।
না, তুমিই কেঁদে ফেলবে’। ছোটটি জওয়াব দিলো।
তাহলে এসো।’ বড়টি বুক ফুলিয়ে বললো।
নিষ্পাপ বালকেরা একে অপরের উপর হামলা শুরু করলো। মেয়েটি পেরেশান হয়ে তামাশা দেখতে লাগলো। মেয়েটির নাম উযরা, ছোট ছেলেটির নাম নয়ীম আর বড়টি আবদুল্লাহ। আব্দুল্লাহ নয়ীম থেকে তিন বছরের বড়। তার ঠোঁটের উপর লেগে আছে এক টুকরা মিষ্টি হাসি, কিন্তু নয়ীমের মুখ দেখে মনে হয়, যেনো সে সত্যি সত্যি লড়াইয়ের ময়দানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়ীম হামলা করছে, আর আব্দুল্লাহ ধীরভাবে প্রতিরোধ করছে। আচানক নয়ীমের ছড়ি তার বায়ুতে লেগে গেলো। আব্দুল্লাহ্ এবার রাগ করে হামলা করলো। এবার নয়ীমের কজীতে চোট লাগলো, আর তার হাতের ছড়িটা ছিটকে পড়ে গেলো।
আব্দুল্লাহ বললো, “দেখো, এবার কেঁদে ফেলো না’।
‘আমি না, তুমি কেঁদে ফেলবে।
নয়ীম রাগে লাল হয়ে তার কথার জওয়াব দিয়ে যমিন থেকে একটা ঢিল তুলে, নিয়ে মারলো আব্দুল্লাহর মাথায়। তারপর নিজের ছডিটা হাতে তুলে নিয়ে ছুটলো ঘরের দিকে। আব্দুল্লাহ্ মাথায় হাত দিয়ে ছুটলো তার পিছু পিছু। কিন্ত এরই মধ্যে নয়ীম গিয়ে সাবেরার কোলের মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করছে।
‘আম্মি! ভাই আমায় মারছে।’ নয়ীম বললো।
আব্দুল্লাহ্ রাগে ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো, কিন্তু মাকে দেখে সে চুপ করে গেলো।
মা প্রশ্ন করলেন, আব্দুল্লাহ, ব্যাপার কি! বলো তো!’
সে জওয়াবে বললো, মা! ও আমায় পাথর মেরেছে।’
‘কেন লড়াই করছিলে বেটা!’ নয়ীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সাবেরা বললেন। ‘আমরা তলোয়ার নিয়ে লড়াই করছিলাম। ভাই আমার হাতে ঘা দিয়েছে আমি তার বদলা নিয়েছি।’