মুসলমান ভাইরা! আমাদের শৌর্য পরীক্ষার সাহস সিন্ধরাজার কি করে হোল, ভেবে আমি হয়রান হচ্ছি। তিনি কি করে বুঝলেন, যে মুসলমান গৃহবিবাদের ফলে এতটা কমজো হয়ে পড়েছে যে, তারা তাদের মা-বোন ও কন্যাদের অবমাননা নীরবে বরদাশত করে যাবে।’
‘বীর মুজাহিদ দল! তোমাদের শৌর্য পরীক্ষার মুহূর্ত সমাগত। আমার মতলব এ নয় যে, তোমরা দীলের মধ্যে প্রতিহিংসাবৃত্তি নিয়ে জেগে উঠবে। সিন্ধুরাজকে আমরা মাফ করতে পারি, কিন্তু মানব-সাম্যের নিশান-বরদার হয়ে আমরা হিন্দুস্থানের মযলুম কওমসমূহের উপর তার নির্মম স্বেচ্ছাচারী শাসন মেনে নেবো না। রাজা দাহির কয়েকজন মুসলমানকে কয়েদখানায় আটক করে আমাদেরকে দাওয়াত করেছেন সিন্ধুর লাখো মানুষকে তাঁর লৌহকঠিন নিষ্পেষণ থেকে নাজাত দেবার জন্য। মুজাহিদ দল! জেগে ওঠ। বিজয়ভেরী বাজিয়ে তোমরা পৌঁছে যাও হিন্দুস্থানের শেষ সীমানা পর্যন্ত।
ইবনে আমেরের বক্তব্য শেষ হবার আগেই ইবনে সাদেক উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বললো :
মুসলমানগণ! আমি ইবনে আমেরকে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি মনে করি। তার আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই; কিন্ত আমার আফসোস এমনি উচ্চ চরিত্রের লোকও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো ক্ষমতালোভীর হাতের ক্রীড়াণকে পরিণত হয়ে তোমাদের সামনে দুনিয়ার শান্তি বিপর্যস্ত করবার ভয়াবহ মন্ত্রণা পেশ করছেন।’
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অতীত যুলুমের ফলে সবরার বেশীর ভাগ লোকই ছিলো তাঁর বিরোধী। তাঁরা বহুদিন ধরে এমন একটি লোকের সন্ধান করেছিলো, যে তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলবার সাহস রাখে। তারা অবাক বিস্ময়ে ইবনে সাদেকের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।
ইবনে আমের কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু ইবনে সাদেকের বুলন্দ আওয়ায় তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠেকে ছাপিয়ে উঠলোঃ
‘সমবেত জনগণ! হকমাত তোমাদেরকে রাজ্য ও গণিমতের আকাংখা ছাড়া অপর কোনো উদ্দেশ্যে এই ধরণের বিজয় অভিযানে উদ্বুদ্ধ করছে না; কিন্তু একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, অতীতে এমনি রাজ্য ও গণিমতের লোভে কতো জান কোরবান করতে হয়েছে, কতো শিশু এতিম ও কতো নারী বিধরা হয়েছে। আমি নিজের চোখে তুর্কিস্তানের ময়দানে তোমাদের নওজোয়ান ভাই-বেটাদের হাজারো লাশ কবর ও দাফন ছাড়া পড়ে থাকতে দেখেছি। কত যখমীকে দেখেছি তড়পাতে আর মাথা খুঁড়ে মরতে। এই অবমাননাকর দৃশ্য দেখে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, মুসলমানের খুন এতটা সস্তা নয় যে, তা হাজ্জাজ বিন্ ইউসুফের নামে বিজয় খ্যাতি ছড়াবার জন্য অকাতরে বইয়ে দিতে হবে।’
মুসলমান ভাইরা! জিহাদের বিরোধীতা আমি করছি না। কিন্তু আমি অবশ্য বলবো যে, গোড়ার দিকে আমাদের জিহাদের প্রয়োজন হয়েছিলো; কারণ আমরা ছিলাম কমযোর এবং কাফের শক্তি আমাদেরকে হটিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। এখন আমরা শক্তিমান। কোনো দুশমনের ভয় নেই আমাদের। এখন আমাদেরকে নযর দিতে হবে দুনিয়াকে শান্তির আবাস বানানোরদিকে।’
মুসলমান ভাইরা! হাজ্জাজের রাজ্যলোভ চরিতার্থ করবার জন্য যে, সব যুদ্ধ করা হচ্ছে, তার সাথে জিহাদের লেশমাত্র সম্পর্ক থাকতে পারে না। .. সমবেত জনগণকে ইবনে সাদেকের কথায় প্রভাবিত হতে দেখে ইবনে আমের বুলন্দ আওয়াযে বলেঃ মুসলমান ভাইরা! আমার ধারণা ছিল না যে, আজো আমাদের মধ্যে এমনি অনিষ্টকারী মওজুদ রয়েছে, যে…….!
ইবনে সাদেক ইবনে আমেরের কথা শেষ হতে দিলো না। সে বুলন্দ আওয়াযে বলে উঠলোঃ আমার বলতে শরম বোধ হচ্ছে যে, ইবনে আমেরের মতো সম্মানিত ব্যক্তিও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের গুপ্তচরের শামিল।
‘হাজ্জাজের গুপ্তচরকে বাইরে বের করে দাও।’ বলে উঠলো ইবনে সাদেকের এক সাথী।
ইবনে সাদেকের কৌশল সফল হলো। কেউ কেউ হাজ্জাজের গুপ্তচর বলে চীৎকার জুড়লো, কেউ কেউ আবার ইবনে আমেরকে অপমানজনক গালি-গালাজ করতে লাগলো। ইবনে আমেরের এক শাগরেদ, এক ব্যক্তির মুখে শ্রদ্ধেয় ওসতাদের গালমন্দ বরদাশত করতে না পেরে তার মুখের উপর এক চর বসিয়ে দিলো। ফলে মসজিদের রীতিমতো হাংগামা বেধে গেলো। জনগণ পরস্পর ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলো।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এতক্ষণে ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। তাঁর হাত বারংবার তলোয়ারের কব্জির দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিচ্ছেন ওসতাদের ইশারায় আর মসজিদের মর্যাদার খাতিরে।
এমনি এক নাযুক পরিস্থিতিতে নয়ীম জনতার ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন মিম্বরের দিকে। তারপর মিম্বরে উঠে কুরআনে করীম তেলাওয়াত করতে শুরু করলেন বুলন্দ ও শিরীন আওয়াযে। কুরআনের আওয়ায সমবেত জনতার মধ্যে প্রশান্ত ভাব ফিরিয়ে আনলো এবং তারা পরস্পরকে চুপ করবার পরামর্শ দিতে লাগলো। ইবনে সাদেক এসেছে জলসার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেবার জন্য। তাই তার ইচ্ছা, আর একবার একটা হাংগামা সৃষ্টি হোক। কিন্ত কুরআন তেলাওয়াতের ফলে আওয়ামের মনোভাব আর নিজের জানের আশংকা বিবেচনা করে সে চুপ করে গেলো। জনতা চুপ করে গেলে নয়ীম শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতাঃ
বসরার বদ-কিসৎ লোকেরা! তোমরা খোদার কহরের ভয় করো এবং ভেবে দেখো, তোমরা কোথায় দাঁড়িয়ে কি করছে। আফসোস্! যেসব মজিদ গড়ে তোলার জন্য তোমাদের পূর্বপুরুষরা পেশ করতেন দেহের খুন আর অস্থি, আজ তোমরা সেই মসজিদে ঢুকেও গোলযোগ পয়দা করতে দ্বিধা করছে না।’