আব্দুল্লাহ বললেন, তুমি কি মনে কর, নিজের খুশীর জন্য আমি আমার ছোট .ভাইয়ের সারা জীবনের খুশী কোরবান হতে দেবো?’
‘আমায় আর শরম দেবেন না আপনি।
‘তোমার জন্য কিছুই করছি না আমি। তোমার চাইতে উযরার খুশীর দিকেই আমার ন্যর বেশী। আগে থেকেই আমি ওকে তোমার জোড়া মনে করেছি। তুমি আমার জন্য যা কিছু করতে চাচ্ছ তাই আমি করছি উযরার জন্য। যাও, ভোর হয়ে এলো। কাল পর্যন্ত অবশ্যি ফিরে আসবে। মামুজান হয়তো তোমার সাথেই চলে আসবেন। চলো।’
ভাই, কি বলছেন আপনি? আমি যাবো না।’
নয়ীম যিদ করো না। উযরাকে খুশি রাখবার দায়িত্ব আমাদের দু’জনেরই।’
ভাই….।
‘চলো। আব্দুল্লাহ মুখের ভাব বদল করে বললেন এবং নয়ীমের বায়ু ধরে কামরা থেকে বাইরে গেলেন।
উযরা তাদেরকে দেখে ছুটে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানার উপর। নয়ীমকে ইতস্ততঃ করতে দেখে আব্দুল্লাহ নিজে আস্তাবলে গিয়ে নিয়ে এলেন তার ঘোড়া। তারপর দু’ভাই বেরিয়ে গেলেন বাড়ির বাইরে। খানিকক্ষণ পরেই উযরার কানে এলো ঘোড়ার পায়ের আওয়া।
আব্দুল্লাহ ফিরে এসে আল্লাহর দরগায় শোকর গোজারী করবার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন।
ভোরবেলা সাবেরা নয়ীমের বিছানা খালি দেখে আস্তাবলের দিকে গেলেন। আব্দুল্লাহ তখন সেখানে তার ঘোড়ার সামনে চারা দিচ্ছিলেন। সাবেরা নয়ীমের ঘোড়া না দেখে পেরেশান হয়ে দাঁড়ালেন। আব্দুল্লাহ তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলেন, আমি! নয়ীমকে তালাশ করছেন আপনি?
হাঁ হাঁ, কোথায় নয়ীম?’
সে একটা জরুরী কাজে গেছে বসরায়। আব্দুল্লাহ জওয়াবে বললেন। তারপর খানিকক্ষণ কি যেন চিন্তা করে মাকে শুধালেন, “আম্মি, নয়ীমের শাদী কবে হবে?
‘তোমার শাদী তো হোক বেটা, তার পালাও আসবে’!
‘আম্মি, আমার ইচ্ছা, ওর শাদী আমার আগেই থোক।
‘বেটা। আমি জানি, সে তোমার কত আদরের। তার সম্পর্কে আমি গাফেল নই। তার জন্য আমি সম্পর্ক তালাশ করছি বই কি। খোদার ইচ্ছায় হয়তো উযরার মতো কোন মেয়ে মিলে যাবে।’
‘আম্মি! উযরা আর নয়ীম তো ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের সাথী।
‘হাঁ, বেটা।
আম্মিজান, আমার ইচ্ছা, ওরা চিরকাল এমনি একত্র হয়ে থাক।’
“তোমার মতলব তা হলে…..
‘জি, হা, আমার বড়ো সাধ, উযরার শাদী নয়ীমের সাথেই হোক।’
সাবেরা হয়রান হয়ে আব্দুল্লাহর দিকে তাকালেন এবং স্নেহ আদরে দু’হাত তার মাথার উপর রাখলেন।
ছয়
বসরা শহরে প্রবেশ করেই নয়ীমের দেখা হলো এক সহপাঠীর সাথে। তাঁর নাম তালহা। তাঁর মুখে নয়ীম শুনলেন, জুমাআর নামাযের পর শহরের মসজিদে এক যবর দস্ত জলসা হবে আর তাতে সভাপতিত্ব করবেন ইবনে আমের। মুসলিম বাহিনী সিন্ধুর উপর হামলা করবার সংকল্প করেছে এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব সৌপর্দ করা হয়েছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বসরার লোকদের জিহাদের পথে উদ্বুদ্ধ করবার দায়িত্ব ইবনে আমেরর উপর ন্যস্ত করে নিজে রওয়ানা হয়ে গেছেন কুফার লোকদের ফউজে ভর্তি করবার জন্য। ইবনে আমেরের বক্তৃতা শুনে বসরার লোকদের মধ্যে আশাব্যঞ্জক অবস্থা সৃষ্টি হবে, এরূপ আশা করবার কারণ রয়েছে, কিন্ত জামা’আতের কতগুলো দুষ্ট লোক গোপনে গোপনে বিরোধিতা করছে সিন্ধুর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার। তারা জলসায় শরীক হয়ে হয়তো একটা ভয়াবহ পরিস্থতি সৃষ্টি করে তুলবে, অমনি একটা আশংকা দেখা যাচ্ছে।
নয়ীম তালহার সাথে কথা বলতে বলতে গেলেন তার বাড়িতে এবং সেখানে ঘোড়া রেখে দু’জন রওয়ানা হলেন মসজিদের দিকে। মসজিদে সেদিন জনসমাগম হয়েছে বরাবরের চাইতে বেশী।
নামাযের পর ইবনে আমের বক্তৃতা করতে উঠলেন মিম্বরের উপর। তিনি কোনো কথা বলবার আগেই বাইরে থেকে দু’হাজার লোকের একটি দল কোলাহল করতে করতে এসে ঢুকলো মসজিদে। তাদের পরোভাগে একটি মোটাসোটা লোক। পরিধানে তার কালো জুব্বা। মাথায় সাদা পাগড়ী ও গলায় ঝুলছে বহুদামী মোতির হার। তালহা আগন্তুকের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘দেখুন, এই যে ইবনে সাদেক এলো। আমার ভয় হচ্ছে, লোকটা নিশ্চয়ই জলসায় কোনো হাংগামা পয়দা করবে।’
ইবনে সাদেক নয়ীমের আসন থেকে কয়েগজ দূরে বসে পড়লো আর তার দলের লোকেরাও এদিক-ওদিক তাকিয়ে বসে পড়লো।
ইবনে আমের তাদের চুপ করে বসবারু ইনত্যের করলেন এবং শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা শুরু করলেনঃ
রসূলে খোদার পেথে জীবন উৎসর্গকারী বীরদের সন্তান-সন্ততি! বিগত আশি নব্বই বছর ধরে দুনিয়া ধরে দুনিয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের শৌর্য-বীর্যের, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এবং পরাক্রম ও শক্তির পরীক্ষা নিয়েছে। সে যামানায় আমরা দুনিয়ার বড় বড় শক্তির মোকাবিলা করেছি। বড় বড় পরাক্রান্ত ও গর্বিত বাদশার মস্তক অবনমিত হয়েছে আমাদের সামনে। আমাদের সৌভাগ্যের কাহিনী শুরু হয়েছে তখন থেকে, যখন কুফরের ঘূর্ণিঝড় রিসালতের দীপশিখার আকর্ষণে ধাবমান পতংগদলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে এগিয়ে এসেছে মদীনার চার দেয়ালের দিকে; তখন ইসলামের বৃক্ষমূল বুকের খুনে সিঞ্চিত করে উর্বর করে তুলবার মানসে রসূল (সঃ) পথে আত্মদানকারী তিনশো তেরো জন বীর সিপাহী কাফের বাহিনীর তীর, নোহ্ ও তলোয়ারের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এই আযীমুশশান বিজয়ের পর তওহীদের ঝান্ডা উঁচু করে আমরা কুফরের অনুধাবন করে ছড়িয়ে পড়েছি দুনিয়ার দিক-দিগন্তরে। বিপুল বিরাট দুনিয়ায় রয়েছে বহু অঞ্চল, যেখানে খোদার আখেরী পয়গাম আজো পৌঁছে নি। আমাদের কর্তব্য, আমাদের প্রভু প্রতিপালকের পয়গাম আমরা দুনিয়ার সকল দেশে পৌঁছে দেবো। আমাদের রসূল (সঃ) যে কানুন বয়ে এনেছেন, তা আমরা জানিয়ে দেবো দুনিয়ার তামাম মানুষকে। তারই বদৌলতে দুনিয়ায় কায়েম হবে শান্তি, আর দুনিয়ায় কমজোর ও শক্তিমান কওমসমূহ মিলিত হয়ে গড়ে তুলবে মানব-সাম্যের এক বিপুল ক্ষেত্র। মযলুম অসহায় মানুষ আবার ফিরে পাবে তাদের হারানো অধিকার। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, আজ পর্যন্ত দুনিয়ার যে কোনো শক্তিই এই আযীমুশশান ও আলমগীর কানুনের মোকাবিলা করতে দাঁড়িয়েছে, তারই ভাগ্যলিপি হয়েছে ধ্বংস।