নয়ীম। কোথায় যাচ্ছো তুমি?
‘উযরা তুমি? তুমি জেগে উঠেছে?
‘কখনই বা আমি ঘুমিয়েছিলাম? দেখো নয়ীম….।
‘উযরার মুখ থেকে আর কোন কথা বেরুলো না। কথা শেষ না করেই সে এগিয়ে গিয়ে নয়ীমের হাত থেকে ঘোড়ার বাগ ধরলো।
উযরা, আমায় বাধা দেবার চেষ্টা করো না। যেতে দাও আমায়।
‘কোথায় যাবে, নয়ীম? বহুকাল পরে উযরা নয়ীমকে নামধরে ডাকছে।
কয়েকদিনের জন্য আমি বসরা যাচ্ছি, উযরা।
কিন্তু এ সময়ে কেন?
উযরা, কেন এ সময়ে যাচ্ছি, জানতে চাচ্ছ? তুমি জানোনা কিছুই?
উযরা সবই জানে। তার দীল ধক ধক করছে। ঠোঁট কাঁপছে। নয়ীমের ঘোড়ার বাগ ছেড়ে অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ দুটি দু’হাতে চেপে ধরলো সে।
নয়ীম বললেন, তুমি হয়তো জানো না উযরা, তোমার অশ্রুর কি দাম আমার কাছে। কিন্তু আমার এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমি নিজে এমনি উদাস থেকে তোমাদের পীড়িত করে তুলছি। বসরায় কয়েকদিন থেকে আমার তবিয়ৎ ঠিক হয়ে আসবে। তোমাদের শাদীর দু’একদিন আগেই আমি ফিরে আসার চেষ্ট করবো। উযরা! একটা কথায় আমি খুশী হয়েছি, আর তোমারও খুশী হওয়া উচিত। তোমার স্বামী হবেন যিনি, তিনি আমার চাইতে অনেক বেশী গুণের অধিকারী। আহা! তুমি যদি জানতে, আমার ভাইকে আমি কতো ভালোবাসি! এ অশ্রু তাঁর কাছে যেনো ধরা না পড়ে কোনোদিন।
তুমি সত্যি সত্যি চললে? উযরা প্রশ্ন করলো।
‘আমি চাই না যে, এমনি করে হররোজ আমার সংযমের পরীক্ষা চলতে থাক। “উযরা আমার দিকে অমনি করে চেয়ো না। তুমি যাও।’
উযরা আর একটি কথাও না বলে ফিরে এলো। কয়েক কদম এসে একবার সে ফিরে তাকালো নয়ীমের দিকে। এক পা ঘোড়ার রেকাবে রেখে নয়ীম তখনো তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উযরা দ্রুত পা ফেলে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ফেললো।
নয়ীম ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে মাত্র কয়েক কদম এগিয়ে গেছেন, অমনি তার পিছন থেকে কে যেনো ছুটে এসে তার ঘোড়ার বাগ ধরলেন। নয়ীম অবাক-বিস্ময়ে দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ। ভাই! নয়ীম হয়রান হয়ে বললেন।
নীচে নেমে এসো।’ আব্দুল্লাহ কাঠোর আওয়াযে বললেন।
ভাই, আমি বাইরে যাচ্ছি।’
‘আমি জানি। তুমি নীচে নেমে এসো।
নয়ীম ঘোড়া থেকে নামলেন। আব্দুল্লাহ এক হাতে ঘোড়ার বাগ ও অপর হাতে নয়ীমের বায়ু ধরে ফিরে চললেন। বাড়ির সীমানায় পৌঁছে তিনি বললেন, ঘোড়া আস্তাবলে বেঁধে এসো।
নয়ীমের কিছু বলবার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু আব্দুল্লাহ তাঁর সামনে এমন এক গুরুগম্ভীর প্রভুত্বব্যঞ্জক রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে, তাঁর হুকুম মেনে চলা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই তার। তিনি ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে এসে আবার দাঁড়ালেন ভাইয়ের কাছে। উযরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছেন এ অপূর্ব দৃশ্য। আব্দুল্লাহ আবার নয়ীমের বায়ু ধরে তাঁকে নিয়ে চলে গেলেন ঘরের একটি কামরায়।
উযরা কাঁপতে কাঁপতে উটে চুপি চুপি পা ফেলে সেই কামরার কাছে গিয়ে দরযার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো আব্দুল্লাহ ও নয়ীমের কথাবার্তা।
‘বাতি জ্বালাও।’ আব্দুল্লাহ বললেন। নয়ীম বাতি জ্বালালেন। কামরার মধ্যে একটা বড়ো পশমী কাপড় বিছানো। আব্দুল্লাহ তার উপর বসে নয়ীমকে ইশারা করলেন বসতে!
‘ভাই, আমাকে কি বলতে চান আপনি?
‘কিছু না, বসে পড়।
আমি যাচ্ছিলাম এক জায়গায়।
‘তোমায় আমি যেতে মানা করবো না। বসো। তোমার সাথে একটা জরুরি কাজ আছে আমার।’ নয়ীম পেরেশান হয়ে পড়লেন। আব্দুল্লাহ কাগজ-কলম বের করলেন একটা সিন্দুক থেকে। তারপর শুরু করলেন একটা কিছু লিখতে। লেখা শেষ করে আব্দুল্লাহ নয়ীমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি সহকারে বললেন, ‘নয়ীম, তুমি বসরায় চলে যাচ্ছ?”
ভাই, আপনি যে গুপ্তচর, তা আমার জানা ছিলো না। জওয়াবে নয়ীম বললেন।
আমি মাফ চাই, নয়ীম! আমি তোমার নই, উযরার গুপ্তচর। ভাইজান, অত শিগগীর আপনি উযরা সম্পর্কে কোনো রায় কায়েম করবেন না।
এই জওয়াব শুনে আব্দুল্লাহ নয়ীমের মুখের দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। নয়ীম ভয় পেয়ে ঘাড় নীচু করলেন। আব্দুল্লাহ আদর করে এক হাতে তাঁর চিবুক স্পর্শ করে মুখখানা উপরে তুলে ধরে বললেন, নয়ীম! আমি তোমার ও উমরার সম্পর্কে কখনো ভূল ধারণা পোষণ করতে পারি না। তুমি আমার চিঠিখানা বসরায় মামুর কাছে নিয়ে যাবে।’
এই বলে আব্দুল্লাহ তাঁর লেখা চিঠিটা এগিয়ে দিলেন নয়ীমের হাতে।
‘ভাইজান এতে কি লিখেছেন আপনি?
‘তুমি নিজে পড়ে দেখো। এতে আমি তোমার সাজার ব্যবস্থা করেছি।’
নয়ীম চিঠিটা পড়লেনঃ
প্রিয় মামুজান! আসোলামু আলাইকুম! যেহেতু উযরার ভবিষ্যত সম্পর্কে আপনার মতই আমিও উদ্বিগ্ন, তাই আমি আমার নিজের চাইতে নয়ীমকে তার ভবিষ্যতের মোহাফিয ও আমানতদার হতে দেখলে আরো বেশি খুশী হবো। আর বেশি কি লিখবো? এ চিঠি কেন লিখছি, তা আপনি বুঝবেন। আশা করি, আপনি আমার কথায় আমল দেবেন। আমার ছুটি শেষ হবার আগেই নয়ীম ও উযরার শাদী হয়ে যাক এই আমার ইচ্ছা। সুবিধা মতো তারিখ আপনি নিজে ধার্য করে দেবেন।
আপনার আব্দুল্লাহ।
চিঠি শেষ করতে করতে নয়ীমের চোখ আঁসুতে ভরে উঠলো। তিনি বললেন, “ভাই আমি এ চিঠি নিয়ে যাবো না। উযরার শাদী আপনার সাথেই হবে। আমায় মাফ করুন ভাই।’