সামাজিক উপন্যাস যেমন পাঠককে সমাজ-সচেতন করে তোলে, ঐতিহাসিক উপন্যাস তেমনি পাঠককে করে তোলে ইতিহাস-সচেতন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম বিশ্বের সমসাময়িক বিপর্যয়সমূহের কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এর মূলে রয়েছে তিনটি বড় কারণ। আদর্শবিমুখতা, বিজ্ঞানবিমুখতা ও ইতিহাসবিমুখতা। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর একটি অংশের মধ্যে আদর্শ-চেতনা নতুন করে দেখা দিলেও বিজ্ঞান মনস্কতা তার অনুসঙ্গী হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানের এ যুগে বিজ্ঞানমনস্কতা ছাড়া কোন জাতিই যে টিকে থাকতে পারবে না, তার প্রমাণ তো পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিনই। একইভাবে বলা যায় মুসলমানদের আদর্শ-চেতনা কখনই ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠতে পারবে না, যদি না তাদের মধ্যে গভীর ইতিহাস-চেতনা সঞ্চারিত হয়। ইতিহাস-চেতনা ছাড়া আমরা যেমন উম্মাহর প্রকৃত শত্রু-মিত্র চিনতে পারি না, তেমনি বুঝতে পারি না, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কতভাবে কত কৌশলে কত ছদ্মবেশে জাতির শত্রুরা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে, বিপর্যস্ত করেছে। আদর্শের বীজ শূন্যে উপ্ত হয় না, হয় জমিনে, জমিনের মানুষদের মনে, যাদের থাকে একটা ইতিহাস। আবার আগাছাদের আগ্রাসনে আদর্শের চারাগাছ যখন বিপর্যস্ত হয়, তখনও তাদের অবস্থান থাকে একটা জমিনে, যার একটা ইতিহাস থাকে। ইতিহাস ছাড়া কোন আদর্শেরই বাস্তবায়ন-প্রয়াস কল্পনা করা যায় না। ইসলামেরও নয়। ইতিহাস অধ্যয়ন ছাড়া যারা আদর্শ বাস্তবায়নের চিন্তা করে তাদের প্রয়াস এ কারণেই অন্ধ প্রয়াস হিসাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।
জাতির ইতিহাস-বিমুখতা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন ইতিহাস-চেতনা। আর ইতিহাস-বিমুখ জাতির মধ্যে ইতিহাস-মনস্কতা সৃষ্টির ব্যাপারে ঐতিহাসিক উপন্যাস পালন করতে পারে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ঔষধ সেবনে অনিচ্ছুক রোগীর জন্য যেমন সুগার-কোটেড ঔষধের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য, তেমনি ইতিহাস-বিমুখ জাতির মধ্যে ইতিহাস-চেতনা সৃষ্টিতেও ঐতিহাসিক উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই নিরিখেই মুসলিম বিশ্বকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভুমিকা বিচার করতে হবে। কিন্তু এখানেও আমাদের দুর্ভাগ্য, বর্তমান মুসলিম ঐতিহাসিক উপন্যাসিকের সংখ্যা একেবারেই আংগুলে গুনে শেষ করা যায়। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের যে স্বল্প সংখ্যক লেখক সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখায় সার্থক কলম সৈনিকের ভূমিকা পালন করছেন নসীম হিজাযী তাদের শীর্ষস্থানীয়। নসীম হিজাযী সেই সব সার্থক সাহিত্যিকদের অন্যতম। যাদের লেখায় মুসলমানদের অতীত শৌর্য-বীর্য, জয়-পরাজয়ের ইতিহাসই শুধু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেনা, পাঠককে ঈমানের বলে বলিয়ান এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির স্বপ্নে উদ্দীপ্ত করে তোলে।
মরণজয়ী’ নসীম হিজাযীর জনপ্রিয় ঐতিহাসিক উপন্যাস সমূহের অন্যতম। মরণ জয়ী’ পঁয়ত্রিশ থেকে পচাত্তর হিজরী পর্যন্ত সময়কালের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস। মুসলমানদের উত্থান-পতনের বৈচিত্র্যময় ইতিহাসে এই চল্লিশ বৎসর যে কোন বিচারে ছিল এক ক্রান্তিকাল। এই মুদ্দতকালেই আলমে ইসলামের সীমা একদিকে স্পেন ছাড়িয়ে ফ্রান্সের গিরিনিজ পর্বতমালা, অপরদিকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত, একদিকে অফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, অপরদিকে মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্থান তাতারস্থান পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সুবাদে প্রথমবারে মত রাগ্রস্ত হয়। এ ছিল সেই কাল, যখন মুসলিম বীর মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয়ের গৌরব অর্জন করেন, মহাবীর মুসা স্পেন বিজয় করেন, আর মধ্য এশিয়াকে আলমে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত করেন কুতায়বা বিন মুসলিম। ভাগ্যের চরম পরিহাস, মুসলিম উম্মাহর চিহ্নিত গোপন দুশমনের পরিকল্পিত চক্রান্তের ফলে এই মুসলিম বীরদের প্রত্যেকেই জিল্লতির পরিণাম বরণে বাধ্য হন। উপন্যাসের সার্থকতার প্রয়োজনে নসীম হিজাযী এ বইয়ে সৃষ্টি করেছেন কিছু কাল্পনিক চরিত্র, কাহিনীর জাল বুনতেও অনিবার্যভাবে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এতে ইতিহাসের মূল সত্য কোথাও বিকৃত হয়নি। মরণ জয়ী এমন এক উপন্যাস, যা একবার পড়া শুরু করে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাঠককে থামতে দেয় না। এখানেই উপন্যাসখানির সার্থকতা।
বাংলা সাহিত্যে ইসলামের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংখ্যা একেবারেই কম। এ ব্যাপারে সার্থক সৃষ্টির প্রশ্নে প্রথমেই নাম ওঠে মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুর। কিন্তু বিষাদ সিন্ধু’ চরম ইতিহাস-বিকৃতির দোষে দুষ্ট। বাংলা সাহিত্যে এ ধারার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি শেখ হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্বের ‘আলমগীর’। এ ধারায় অন্যান্য যারা ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন তাদের মধ্যে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, খালেক দাদ চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, এম এ হাশেম খান, রাজিয়া মজীদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে অবশ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের তুলনায় ঐতিহাসিক নাটকের সাক্ষাৎ বেশী পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে শাহযাদাৎ হোসেন, আকবর উদ্দীন, ইব্রাহীম খাঁ, আবুল ফজল প্রমুখের সূচিত সৃষ্টি ধারা ব্যাপক সার্থকতা লাভ করেছে আসকার ইবনে শাইখে এসে। উর্দু সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসে নসীম হিযাজী যে স্থান করে নিয়েছেন, আসকার ইবনে শাইখ বাংলা ঐতিহাসিক নাটকে অনুরূপ স্থান অধিকার করতে যাচ্ছেন বললে মোটেই অতিরিক্ত বলা হয় না। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমাদের দীনতা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।