আব্দুল্লাহর শাদীর আর এক হফতা বাকী। নয়ীম এক রাত্রে লোকালয়ের বাইরে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেড়াচ্ছান। আসমানে ঝিকিমিকি করছে সিতারার দল। চাঁদের মন-ভোলানো দীপ্তিতে ঝকঝক করছে মরুভূমির বাল তরংগ। লোকালয়ে আল্লাহর শাদীর খুশীতে নওজোয়ান মেয়েরা গান গাইছে দফ বাজিয়ে। নয়ীম ঘোড়া থামিয়ে খানিক্ষণ শুনলেন সে সংগীত সুর। তিনি ছাড়া গোটা সৃষ্টিই যেনো আজ আনন্দে মশগুল। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি শুয়ে পড়লেন ঠান্ডা বালুর বিছানায়। চাঁদ, সিতারা, ঠান্ড মন-ভোলানো হাওয়া আর এলাকার বাগ-বাগিচা মুগ্ধকর দৃশ্য যেনো তার নিষ্পাপ দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়া প্রশান্তির জন্য তাকে আবার পাগল করে তুললো। আপন মনে তিনি বলতে লাগলেন।
‘আমি ছাড়া সৃষ্টির প্রতি অণু-পরমাণু আনন্দে বিভোর। এই বিপুল প্রসারের মাঝখানে আমার হাহাকারের বাস্তবতা কতটুকু। ওহ! ভাই ও মায়ের খুশী, মামুর খুশী এবং হয়তো উযরার খুশীও আমার বিষণ্ণ ও মর্মাহত করে তুলেছে। কতো স্বার্থপর আমি।…..কিন্তু স্বার্থপরও তো নই আমি। ভাইয়ের জন্যই তো আমি আমার নিজের বশী কোরবান করে দিয়েছি!…… কিন্তু তাও মিথ্যা! আমার দীলের মধ্যে ভাইয়ের জন্য এতটুকু ত্যাগের মনোভাব নেই যে, তার খুশীতে শরীক হয়ে আমি আপনার দুঃখ বেদনা ভুলে যাবো। রাতদিন এমনি করে বাইরে থাকা, কোন কথা না বলা, এমনি বেদনাতুর হয়ে থাকা তার কাছে কি প্রকাশ করেছে…..! আর আমি এমন করবো না। তিনি আমার বিষণ্ণ মুখ আর দেখবেন না!….. কিন্তু তাও তো আমার হাতে নেই কিছু! আমি হয়তো দীলের আকাংখা সংযত করে রাখতে পারি, কিন্তু অনুভূতিকে তো সংযত করতে পারব না। তার চাইতে ভালো, আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যাই। …….হাঁ আমার অবশ্যি চলে যেতে হবে …..এখুনি চলে যাচ্ছি না কেন?…..কিন্তু না, এমনি করে নয়। ভোরের দিকে মায়ের এজাযত নিয়ে তবে যাবো।’
এই সংকল্প নয়ীমের দীলের কিছুটা আশ্বস্ত করলো।
পরের দিন ভোরে ফজরের নামায পড়ে নয়ীম-মায়ের কাছে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য বসরা যাবার এজাযত চাইলেন।
বেটা! তোমার ভাইয়ের শাদী! তুমি ওখানে যাবে কি আনতে?
আম্মি! শাদীর একদিন আগেই আমি এসে যাবো।’
না বেটা! শাদী পর্যন্ত তোমায় থাকতেই হবে বাড়িতে।
‘আম্মি! আমায় এজাযত দিন।’
সাবেরা রাগের ভাব দেখিয়ে বললেন, নয়ীম, আমার ধারণা ছিলো তুমি সত্যি সত্যি এক মুজাহিদের বেটা, কিন্তু আমার অনুমান ভুল হয়েছে। আপন ভাইয়ের খুশীতে শরীক হতে তুমি চাও না। নয়ীম, তোমার ও আব্দুল্লাহর মধ্যে ঈর্ষা?
ঈর্ষা? আম্মা, আপনি কি বলছেন? ভাইয়ের প্রতি আমি ঈর্ষা কেন পোষণ করবো? আমি তো চাই, আমার সবটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আমি তাকেই নযরানা দেবো।
নয়মের কথাগুলো সাবেরার অন্তর স্পর্শ করলো। খানিকক্ষণ নির্বাক থেকে তিনি বলে উঠলেন ‘বেটা! খোদা করুন, আমার এ ধারণা যেনো মিথ্যাই হয়। কিন্তু তোমার এমনি নীরবতা, অকারণ মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর অর্থ আর কি হতে পারে?
‘আম্মি, আমি মাফ চাচ্ছি।’
সাবেরা এগিয়ে এসে নয়ীমকে বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘বেটা মুজাহিদের সিনা প্রশস্ত হয়েই থাকে।’
সন্ধ্যা বেলায় নয়ীম আর বাইরে গেলেন না। রাতের খানা খেয়ে বিছানায় পড়ে তিনি বিভোর হয়ে রইলেন গভীর চিন্তায়। তার দীলের মধ্যে আশংকা জাগলো, তার চালচলনে মায়ের মনে যে ধারণা জন্মেছে, আব্দুল্লাহর মনেও যদি তেমনি হয়ে থাকে!
এই চিন্তা তার বাড়ী চলে যাবার ইরাদা আরো মযবুত করে দিলো। ( মধ্য রাত্রে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। তারপর কাপড় বদল করে আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার উপর যিন বাঁধলেন। ঘোড়া নিয়ে বাইরে যাবার মতলব করতেই তার দীলের মধ্যে জাগলো এক নতুন খেয়াল। ঘোড়া সেখানেই রেখে তিনি আঙিনা পার হয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন উযরার বিছানার পাশে।
উষরাও কয়েকদিন ধরে রাত জেগে কাটাচ্ছে নয়ীমের মতো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে দেখছে নয়ীমের কার্যকলাপ। নয়ীম কাছে এলে তার দীলের মধ্যে জাগলো প্রচন্ড কম্পন। ঘুমের ভান করে সে পড়ে রইলো চোখ বন্ধ করে। নয়ীম বহু সময় দাঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মূর্তির মতো। চাঁদের রোশনী এসে পড়েছে উযরার মুখের উপর। মনে হচ্ছে যেনো আসমানের চাঁদ উঁকি মেরে দেখেছে যমিনের চাঁদকে। নয়ীমের দৃষ্টি এমন করে গিয়ে নিবন্ধ হয়েছে উযরার মুখের উপর যে, তিনি খানিকক্ষণের জন্য ভুলে গেছেন চারদিকের বাস্তবকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলে উঠলেন; উযরা, তোমার শাদী মোবাবক হোক।
নয়মের কথায় উযরার সারা দেহে কম্পন অনুভুত হলো। তার মনে হলো, যেনো কেউ তাকে গর্তের ভিতরে ফেলে উপর থেকে মাটি চাপা দিচ্ছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। সে চীৎকার করতে চায়, কিন্ত কোন এক অদৃশ্য হাত যেনো তার মুখ চেপে ধরে জোর করে। সে চায় নয়ীমের পায়ে মাথা রেখে শুধাতে, কি তার কসুর? কেন তিনি এ কথা বললেন? কিন্তু কম্পিত দীলের মধ্যেই গুমরে মরে তা। চোখ খুলে সে নয়ীমের দিকে তাকাতেও পারে না।
ঘোড়া বের করবার জন্য নয়ীম আবার চলে গেলেন আস্তাবলের ভেতরে। উষরা বিছানা ছেড়ে উঠলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। নয়ীম ঘোড়া নিয়ে বাইরে এলেন। উযরা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো নয়ীমের পথরোধ করে।