নয়ীম তিন মাস বাড়িতে থেকে জিহাদে যাবার জন্য বসরার ওয়ালীর হুকুমের ইনতেযার করতে থাকলেন।
ঘরে ফিরে এসে নয়ীমের দিনগুলো খুশীতে কাটবে না, এরূপ প্রত্যাশা তিনি করেননি। যৌবনের প্রথম অনুভূতি উযরা ও তার মাঝখানে সৃষ্টি করে তুলেছে লজ্জার এক দুস্তর ব্যবধান। ছেলেবেলার ফেলে আসা দিনগুলো তার মনে পড়ে, যখন উমরার ছোট্ট হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন লোকালয়ের বাগ-বাগিচায়। সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আজ তাঁর কাছে স্বপ্ন। কম-বেশী করে উযরারও সেই একই অবস্থা। নয়ীম তার ছেলেবেলার সাথী। কিন্তু তার চোখে তিনি যেনো আজ কত নতুন। কোথায় তার চালচলনে দ্বিধা-সংকোচ কমে আসবে, তা না হয়ে যেনো তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। নয়ীম তার দেহ মনকে ঘিরে অনুভব করছেন কারাপ্রাচীরের বন্ধন, তাঁর দীলের উপর চেপে রয়েছে একগুরুতর বোঝ। উযরা তাঁর দীলের তন্ত্রীতে জাগিয়ে তুলেছে মহব্বতের এক ছন্দময় সংগীত সুর তার ছোটবেলা থেকেই। নয়ীম চান, এই মরুদুলালী হুরের সামনে খুলে ধরবেন তার দীলের পর্দা, কিন্ত রাজ্যের লজ্জা এসে যেনো চেপে ধরে তাঁর মুখ। তবু যেনো তারা দু’জনই শুনতে পান পরস্পরের দীলের কম্পন।
নয়ীম ঘরে ফিরবার চার মাস পর আব্দুল্লাহ এলেন ছুটি নিয়ে। সাবেরার ঘরের রওনক দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। রাতের খানা খেয়ে নয়ীম ও আব্দুল্লাহ বসলেন মায়ের কাছে। আব্দুল্লাহ তাদেরকে শুনাচ্ছেন তার.ফউজী তৎপরতার কথা, আরো শুনাচ্ছেন র্কিস্থানের অবস্থা। উযরা আব্দুল্লাহর কথা শুনছে খানিকটা দূরে পাঁচিলের আড়ে গড়িয়ে। আলোচনার শেষে আব্দুল্লাহ বললেন; আমি বসরা হয়ে এসেছি।’
‘তোমার মামুর সাথে দেখা হয়েছিলো?’ সাবেরা প্রশ্ন করলেন।
‘জি হাঁ, দেখা হয়েছে। আপনাকে সালাম জানিয়েছেন তিনি। তা ছাড়া একটা চিঠিও দিয়েছেন আমার হাতে।
কেমন চিঠি?
আব্দুল্লাহ জেব থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, ‘পড়ে দেখুন।
‘তুমিই পড়ে শুনাও বেটা।
‘আম্মিজান! চিঠিটা আপনার নামে।’ আব্দুল্লাহ সলজ্জভাবে জওয়াব দিলেন। সাবেরা-চিঠিটা নয়ীমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা বেটা, তুমিই পড়ো।’ নয়ীম চিঠি হাতে নিয়ে উযরার দিকে তাকালেন। উযরা বাতিটা তুলে নিয়ে নয়ীমের পাশে দাঁড়ালো।
চিঠির বিষবস্তুর দিকে নযর ফেলতেই নয়ীমের দীলের উপর এসে লাগলো এক প্রচন্ড ধাক্কা। মাকে তিনি শুনাতে চান, কিন্তু চিঠিটার কথাগুলো যেনো তার মুখে চেপে ধরেছে। তিনি দ্রুত নযর চালালেন চিঠির আগাগোড়া। চিঠির বিষয়বস্তু নয়ীমের কাছে না-করা গুনাহর সাজা পাবার হুকুমনামার চাইতেও ভয়ানক হয়ে দেখা দিলো। তার ভবিষ্যত সম্পর্কে তকদীরের অমোঘ ফয়সালা পড়ে তিনি যেনো কিছুক্ষণের জন্য সম্বিতহারা হয়ে গেলেন। এক অসহনীয় বোঝা যেনো তাকে টেনে নিচ্ছে দ্বিধাবিভক্ত যমিনের অভ্যন্তরে। কিন্তু মুজাহিদের স্বভাবসুলভ হিম্মৎ হলো জয়ী। অন্তহীন চেষ্টায় তিনি মুখের উপর হাসি টেনে এনে বললেন, মামুন জান ভাইয়ের শাদীর কথা লিখেছেন। পড়ন আপনি।
নয়ীম এই কথাটি বলে চিঠিখানি মায়ের হাতে দিলেন। সাবেরা বাতির আলোর দিকে এগিয়ে পড়তে শুরু করলেন, ‘বোন, উযরার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি এখনও কোন ফয়সালা করতে পারিনি। আমার কাছে আব্দুল্লাহ ও নয়ীম–দু’জনই সমান। উযরার মতো শরীফ খান্দানের মেয়ের ভবিষ্যতের যামিন হতে পারে এমন গুণরাজি এদের দু’জনেরই ভিতরে মওজুদ রয়েছে। বয়সের দিক বিবেচনা করে আব্দুল্লাহকেই এ আমানতের বেশী হকদার মনে হয়। তার দু’মাসের ছুটি মিলেছে। আপনি কোনো পছন্দমতো দিন ধার্য করে আমায় খবর দেবেন। দু’দিনের জন্য আমি চলে আসবো।
এ বাচ্চাদের তবিয়ৎ সম্পর্কে আপনিই আমার চাইতে বেশী ওয়াকেফ। এ উযরার ভবিষ্যতের প্রশ্ন, খেয়াল রাখবেন।–সাঈদ।
*
নয়ীমের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পরিণাম হলো তার প্রত্যাশার বাইরে। তার এতদিনের ধারণা, তিনি উযরার জুন্য আর উয়রাও তারই জন্য। কিন্তু মামুর এখানা চিঠি তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক তিক্ত বাস্তবের মুখোমুখি।
উযরা, তার নিষ্পাপ উযরা! এখন সে তার ভাবী হতে চলেছে। দুনিয়া আর তার ভিতরকার সব কিছুই যেনো তার চোখে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তার দীলের মধ্যে থেকে থেকে জেগে উঠছে এক অপূর্ব বেদনার অনুভূতি, কিন্তু নিজেকে তিনি সংযত করে রেখেছেন যথাসাধ্য। দীলের গোপন ব্যথা তিনি প্রকাশ করেননি কারুর কাছে। উযরার অবস্থায়ও কোনো ব্যতিক্রম নেই।
আব্দুল্লাহ ও সাবেরা নয়ীম ও উমরার পেরেশানীর কারণ জানতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ভাইয়ের প্রতি নয়ীমের ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধা। আর উমরা? সাবেরা, সাঈদ ও আব্দুল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা যেনো তাকে বেঁধে ফেলেছে। তাই দু’জনই রইলেন নির্বাক, কোনো কথাটি বেরুলো না তাদের মুখ থেকে। মনের আগুন মনই পোড়ায়, নেই কোনো দোসর।’
আব্দুল্লাহর আনন্দের দিন যতো ঘনিয়ে এলো নিকটে, ততোই নয়ীম ও উযরার কল্পনার দুনিয়া হয়ে এলো অন্ধকার-তিমিরাচ্ছন্ন। নয়ীমের অশান্ত মনের কাছে ঘরের চার দেওয়ালের ভিতরটা হয়ে এলো জিন্দাখানার মতো। হর রোজ সন্ধ্যায় তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেড়াতে চলে যান দূরে-বহু দূরে। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত মরুপথে ঘুরে বেড়াতে থাকেন এদিক-ওদিক।