উযরা, জওয়াব দিলো, আম্মি আপনি না হলে আমি …….। উযরা আর কিছু বলতে পারলো না। তার চোখ দু’টি হয়ে উঠলো অশ্রুসজল।
উযরা!’ সাবেরা ডাকলেন।
‘জি, আম্মি?
সাবেরা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অমনি-বাইরের দরা খুলে গেলো। এবং ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ এসে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। সাবেরা উঠে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন। আব্দুল্লাহ সালাম করলেন। মা ও ছেলে দাঁড়িয়ে রইলেন সামনাসামনি।
পুত্রকে ছেড়ে মায়ের নযর তখন চলে গেছে দূরে-বহু দূরে। বিশ বছর আগে ঠিক এমনি লেবাস পরে এমনি আকৃতি নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন আব্দুল্লাহর বাপ।
আম্মি!
‘হাঁ বেটা।
আপনাকে আগের চাইতে কমগো মনে হচ্ছে।’
না বেটা। আজতো আমায় কমফের মনে হবার কথা নয়…। দাঁড়াও, আমি তোমার ঘোড়া বেঁধে আসি।…বলে সাবেরা ঘোড়ার বাগ হাতে নিয়ে আদর করে তার গর্দানে হাত বুলাতে লাগলেন।
‘ছাড়ন আম্মি। একি করে হতে পারে?’ মায়ের হাত থেকে ঘোড়ার বাগ ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে আব্দুল্লাহ বললেন।
বেটা, তোমার বাপের ঘোড়া তো আমি বাঁধতাম।’ সাবেরা বললেন।
কিন্তু আপনাকে তকলীফ দেওয়া যে আমি গুনাহ মনে করি।’
যিদ করো না বেটা, ছেড়ে দাও।
আব্দুল্লাহ মায়ের কণ্ঠস্বরে অভিভুত হয়ে ঘোড়ার বাগ ছেড়ে দিলেন।
সাবেরা ঘোড়া নিয়ে আস্তাবলের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই উযরা এসে তাঁর হাত থেকে ঘোড়র বাগ ধরে বললো, “আম্মি। ছাড়ুন। আমি বেঁধে আসি।’
সাবেরা স্নেহ করুণ হাসি-ভরা মুখে উযরার দিকে তাকিয়ে একটুখানি চিন্তা করে ঘোড়ার বাগ ছেড়ে দিলেন তার হাতে।
আব্দুল্লাহ তাঁর ছুটির বিশ দিন কাটিয়ে দিলেন বাড়িতে। বাড়ির অবস্থায় তিনি লক্ষ্য করলেন এক যবরদস্ত পরিবর্তন। উযরা আগেও তাঁর সামনে কিছুটা দ্বিধা সংকোচ নিয়ে চলতো। আর এখন সে যেনো শরমে মরে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে আব্দুল্লাহর ছুটির দিন শেষ হয়ে এলো। অতি আদরের পুত্রের জন্য মায়ের সবচাইতে বড়ো তোহফা ছিলো তার দাদার আমলের একখানি খুবসুরত তলোয়ার।
আব্দুল্লাহ যখন ঘোড়ার সওয়ার হয়েছেন, তখুনি উযরা তার নিজ হাতের তৈরী .একখানা রুমাল সাবেরার হতে দিয়ে সলজ্জভাবে ইশরা করলো আল্লাহর দিকে। রুমাল খুলে আব্দুল্লাহ দেখতে পেলেন, তার মাঝখানে লাল রঙের রেশমী সূতা দিয়ে তোলা রয়েছে কালামে ইলাহীর এই কটি কথাঃ
–অনিষ্ট অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।
আব্দুল্লাহ রুমালখানা জেবের মধ্যে রেখে উযরার দিকে তাকালেন এবং পর মুহূর্তেই তার দিক থেকে ন্যর সরিয়ে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে এজাযত চাইলেন।
সাবেরা মাতসুলভ কোমল ও নায়ক মনোভাব সংযত করে বললেন, এখন আর তোমায় নসীহতের প্রয়োজন নেই। তোমরা কার আওলাদ, তা ভুলে যেয়ো না–তোমার পূর্বপুরুষ কখনো পেছন ফিরে রক্তাদান করেননি। আমার দুধ আর তাদের নামের উযযত রেখে চলবে।’
আব্দুল্লাহর জিহাদে যোগ দেবার পর এক বছর কেটে গেছে। সাবেরার কাছে। তাঁর দেওয়া কয়েক খানা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে যে, পুত্র-গর্বে গর্বিতা মাতার প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সুনাম তিনি হাসিল করছেন। সাঈদের চিঠিতে এবং বসরা থেকে তাদের এলাকায় যারা আসা-যাওয়া করে তাদের মুখে সাবেরা শোনেন মকতবে নয়ীমের সুনাম-সুখ্যাতির খবর। নয়ীমের এক চিঠিতে সাবেরা জানলেন, তিনি শীগগিরই শিক্ষা শেষ করে ফিরে আসবেন বাড়িতে। একদিন সাবেরা বেড়াতে গেলেন পাশের এক বাড়িতে। উযরা তীর-ধনুক নিয়ে আঙিনায় বসে নানা রকম জিনিসের উপর লক্ষ্যভেদ করছে। একটা কাক হঠাৎ উড়ে এসে বসলো উযরার সামনে এক খেজুর গাছের উপর। কাকটা কেবলমাত্র উপরে উটেছে, অমনি অপরদিক থেকে আর একটি তীর এসে তাকে যখম করে নীচে ফেলে দিলো। উযরা হয়রান হয়ে উঠে এসে কাকের দেহ থেকে তীরটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকাতে লাগলো এদিক-ওদিক। ফটকের কাছে গিয়ে সে বাইরে তাকালো। ঘোড়াসওয়ার ফটকরে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হাসিমুখে। উযরার ফরসা চেহারা লজ্জায় ও খুশীতে লাল হয়ে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে সে ফটক খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। নয়ীম ঘোড়া থেকে নেমে এসে ডুকলেন ভিতরে।
নয়ীম বসরা থেকে বাড়ি এসেছেন অনেক কিছু বলবার আর অনেক কিছু শুনবার আকাংখা নিয়ে, কিন্তু অন্তহীন চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর মুখ থেকে একটির বেশী কথা বেরুলো না। তিনি বললেন, ভালো আছ উযরা?’
উযরা কোনো জওয়াব না দিয়ে মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকালো তার দিকে; পরক্ষণেই সে তার চোখ অনবত করলো।
‘ভালো আছি।’
আম্মিজান কোথায়?
তিনি একটি মেয়ের অসুখ দেখতে গিয়েছেন।’
খানিকক্ষণ দুজনই নির্বাক।
‘উযরা, তোমায় আমি হররোজ মনে করেছি।’
উযরা চোখ উপরে তুললো, কিন্তু সিপাহীর লেবাসে সৌন্দর্য ও মহিমার প্রতিমূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভরে দেখবার সাহস হলো না তার।
‘উয়রা, তুমি আমার উপর নারায় হয়েছে?
উযরা জওয়াবে কিছু বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু নয়ীমের রাজকীয় ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
‘আচ্ছ, আমি আপনার ঘোড়াটা বেঁধে রেখে আসি।’ কথার মোড় ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে বললো সে।
না, উযরা! তোমার হাত এসব কাজের জন্য তৈরী হয়নি। নয়ীম এই কথা বলে ঘোড়াটিকে নিয়ে গেলেন আস্তাবলের দিকে।