ইবনে আমেরর শাগরেদদের সংখ্যা বেড়ে চললো দিনের পর দিন, কিন্তু তাঁর উচ্চাকাংখার পূর্ণতার পথে অন্তরায় হলো বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যহীনতা। বসরার ওয়ালীর কাছে তিনি দরখাস্ত করলেন মাদ্রাসার জন্য একজন অভিজ্ঞ ওসতাদের প্রয়োজন জানিয়ে। সাঈদ তখন সাইপ্রাসের ওয়ালী; বসরার ওয়ালী তার চাইতে যোগ্য আর কোন লোককে খুঁজে পেলেন না এ কাজের জন্য। হজ্জাজ খলীফার দরবারে দরখাস্ত করলে সাঈদকে অবিলম্বে বসরায় পৌঁছবার হুকুম দেওয়া হলো।
এক নতুন ওস্তাদ আসছেন, এ খবর নয়ীম ও আব্দুল্লাহর অজানা ছিলো না, কিন্তু তাদের মামুই যে ওস্তাদ হয়ে আসছেন, তা তারা জানতো না। সাইপ্রাসের এক নওমুসলিম পরিবারের মেয়ের সাথে শাদী হয়েছে সাঈদের। বিবিকে সাথে নিয়ে প্রথমে তিনি গেলেন সাবেরার কাছে। তারপর কয়েকদিন সেখানে থেকে চলে এলেন বসরায়। মকতবে এসে তিনি কাজ শুরু করে দিলেন পূণোদ্যোমে। তার ভাগ্নেরাই তার সেরা ছাত্র জেনে তিনি অন্তহীন আনন্দ অনুভব করলেন।
কয়েক মাস পরে আব্দুল্লাহ ও তার জামা’আতের আরো কয়েকটি নওজোয়ান শিক্ষা সমাপ্ত করলো। তাদের বিদায় উপলক্ষে ইবনে আমের যথারীতি এক বিদায় সভা ডাকলেন। বসরার ওয়ালী হাযির থাকলেন সে জলসায়। বিদায়ী ছাত্রদেরকে দরবারে-খিলাফতের তরফ থেকে বিতরণ করা হলো:ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র।
ইবনে আমের তাঁর বিদায় সম্ভাষণে বললেন, নওজোয়ান দল! আজ এক কঠোর বিপদসংকুল দুনিয়ায় পা বাড়াবার সময় এসেছে তোমাদের সামনে। আমি আশা করছি যে, আমার মেহনত ব্যর্থ হয়নি, প্রমাণ করবার জন্য তোমরা প্রত্যেকে চেষ্টা করবে। যে সব কথা তোমাদেরকে বহুবার বলেছি, তা আবার নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই। মাত্র কয়েকটি কথার পুনরাবৃত্তি আমি করাবো। নওজোয়ানরা! যিন্দেগী হচ্ছে এক ধারাবাহিক জিহাদ এবং মুসলমানের যিন্দেগীর পবিত্ৰমত কাজ হচ্ছে তার পরওয়ারদেগারের মুহাব্বতে জান পর্যন্ত বিসর্জন দিতে তৈরী থাকা এবং তোমাদের দীল সেই পবিত্র মনোভাবে পরিপূর্ণ থাকবে। তোমাদের সামনে যেনো দুনিয়া ও আখেরাত দুই-ই থাকে উজ্জ্বল হয়ে। দুনিয়ায় তোমরা সম্মানিত হয়ে শির উঁচু করে চলবে এবং আখেরাতে তোমাদের জন্য জান্নাতের দরযা থাকবে খোলা। মনে রেখো, এই পবিত্র মনোভাব থেকে বঞ্চিত হলে দুনিয়ায় কোনো স্থান থাকবে না তোমাদের এবং আখেরাতও হবে তোমাদের চোখে অন্ধকার। কমযোর তোমাদেরকে এমন করে আকড়ে ধরবে যে, হাত-পা নাড়াবার শক্তিও থাকবে না তোমাদের। কুফরের যেসব শক্তি মুজাহিদের পথে ধূলিকণার মতো উড়ে গেছে, তাই আবার তোমাদের সামনে দেখা দেবে মযবুত পাহাড় হয়ে। দুনিয়ার কূটকৌশলী জাতিসমূহ তোমাদের উপর হবে বিজয়ী এবং তোমাদেরকে বানাবে তাদের গোলাম। এমন সব নির্মম, বিধানের আবর্তে জড়িয়ে পড়বে তোমরা যা থেকে নাজাত পাওয়া হবে অসম্ভব। তখনো তোমরা নিজেকে মুসলমান বলেই দাবী করবে, কিন্তু ইসলাম থেকে তোমরা থাকবে বহুদুর। সত্যের উপর ঈমান এনেও যদি তোমাদের মধ্যে সত্যের জন্যে কোরবানী দেবার আকাংখা পয়দা না হয়, তা হলে বুঝবে যে, তোমাদের ঈমান কমোের। ঈমানের দৃঢ়তার জন্য আগুন ও খুনের দরিয়া অতিক্রম করে চলা অপরিহার্য। মওত যখন তোমাদের চোখে যিন্দেগীর চাইতে প্রিয়তর, তখন বুঝবে যে, তুমি যিন্দাহ-দীল, আর মওতের ভয় যখন তোমার শাহযাদাৎ স্পৃহার উপর হবে বিজয়ী, তখন তোমার অবস্থা হবে এমন এক মুরদার মতো, যে কবরে থেকে হাত-পা ছুঁড়েছে শ্বাস নেবার জন্য।’
ইবনে আমের বক্তৃতার মাঝখানে এক হাতে কুরআন উর্ধ্বে তুলে বললেন; এ আমানত রসূলে মাদানী (সঃ)-এর উপর খোদায়ে কুদুসের তরফ থেকে নাযিল হয়েছে এবং দুনিয়ায় তিনি তার কর্তব্য সমাপন করে এ আমানত আমাদের হাতে সোপর্দ করে গেছেন। হুযুর (সঃ) আপন যিন্দেগীতে প্রমাণ করে গেছেন যে, তলোয়ারের তেষী ও বায়ুর কুওৎ ব্যতীত আমরা এ আমানুতের হেফাযত করতে পারবো না। যে পয়গাম তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে, তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে দুনিয়ার প্রতি কোণে পৌঁছে দেয়া।
ইবনে আমের তার বক্তৃতা শেষ করে বসলেন। তারপর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিস্তারিতভাবে জিহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করে নিজের জেব থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, এ চিঠি মরভের গভর্নরের কাছ থেকে এসেছে। তিনি জৈহুন নদী পার হয়ে তুর্কিস্থানের উপর হামলা করতে চাচ্ছেন। এ চিঠিতে তিনি প্রচুর সংখ্যক ফউজ পাঠাবার দাবী জানিয়েছেন। আপাততঃ কয়েকদিনের মধ্যে আমি বসরা থেকে দু’হাজার সিপাহী পাঠাতে চাচ্ছি। তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে এই ফউজে শরীক হতে রাযী?
ছাত্রদের সবাই তার কথা শুনে হাত উঁচ করে সম্মতি জানালো।
হাজ্জাজ বললেন, আমি তোমাদের জিহাদী মনোভাবের প্রশংসা করি, কিন্তু যারা শিক্ষা সমাপ্ত করেছে, বর্তমান মুহূর্তে আমি বেবল তাদেরকেই দাওয়াত দেবো। এ ফউজরে নেতৃত্ব আমি এই মাদ্রাসারই একটি যোগ্য শিক্ষার্থীর উপর সোপর্দ করতে চাই। আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই শুনেছি। তাই তারই উপর সোপর্দ করছি এ কাজের ভার। তোমাদের ভিতর থেকে যে সব নওজোয়ান তার সাথী হতে রাযী, বিশ দিনের মধ্যে তারা নিজ নিজ ঘর থেকে ঘুরে বসরায় এসে পৌঁছবে।
০৫. সাবেরার নিয়মিত কাজ ছিলো
পাঁচ
সাবেরার নিয়মিত কাজ ছিলো, তিনি রোজ ফজরের নামায শেষ করে উযরাকে সামনে বসিয়ে তার মুখ থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনতেন। উযরার মধুর আওয়ায কখনো কখনো আশেপাশের মেয়েদের পর্যন্ত টেনে আনতো সাবেরার ঘরে। এরপর সাবেরা গাঁয়ের কয়েকটি মেয়েকে পড়াতে ব্যস্থ হতেন আর উযরা ঘরের দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে তীরন্দাযীর অভ্যাস করতো। একদিন সূর্যোদয়ের আগে উযরা যথারীতি কুরআন তেলাওয়াত করে উঠে যাচ্ছে, সাবেরা অমনি তার হাত ধরে কাছে বসিয়ে খানিকক্ষণ সস্নেহ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, উযরা কতোবার আমি ভাবি, তুমি না এলে আমার দিন কতো কষ্টে কাটতো। তুমি আমার নিজের মেয়ে হলেও হয়তো এর চাইতে বেশি স্নেহ আমি তোমায় দিতে পারতাম না।