‘জি হাঁ।’
‘এই ছেলেটির সাথে মোকাবিলা করবে?
‘জি, আমার তেমন বেশি অভ্যাস নেই। তাছাড়া এতে আমার চাইতে বড়োও বটে।’
‘কোনো ক্ষতি নেই তাতে।
কিন্তু আমার ভাই কোথায়?
‘সেও এখানেই আছে। তার সাথে তোমার দেখা করিয়ে দেবো। আগে এর সাথে মোকাবিলা করে দেখাও।
নয়ীম দ্বিধাকুণ্ঠিত পদে ময়দানে নামলো। দর্শকরা এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করলো।
দুই তলোয়ারের ঠোকাঠুকি শুরু হলো। ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগলো তলোয়ারের ঝংকার। নয়ীমের প্রতিদ্বন্দ্বী খানিক্ষণ তাকে ছোট বালক মনে করে শুধু ঠেকাতে লাগলো তার হামলা, কিন্তু নয়ীম আচানক পায়তারা বদলে তার উপর প্রচন্ড আক্রমণ করলো। বালকটি তার অপ্রত্যাশিত হামলা ঠেকাতে পারলো না যথাসময়ে। নয়ীমের তলোয়ার তার তলোয়ারের উপর দিয়ে পিছলে গিয়ে লাগলো তার লোহার টুপিতে। দর্শকরা প্রশংসাসূচক ধ্বনি তুললো।
নয়মের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে ব্যাপার বিলকুল নতুন। রাগে ফুঁসে উঠে সে কয়েকবার আক্রমণ চালালো তীব্রতার সাথে এবং নয়ীমকে পিছন দিকে হটাতে লাগলো। কয়েক কদম হটে যাবার পর নয়ীমের পা কেঁপে গেলে সে চিৎ হয়ে পড়ে গেলো।
নয়মের প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়-গর্বে তলোয়ার নীচু করে তার। উঠে আসার ইনত্যের করতে লাগলো।
নয়ীম রাগে লাল হয়ে উঠে এলো এবং তেগ চালনার যাবতীয় নীতি উপেক্ষা করে অন্তহীন গতি ও বেগ সহকারে হামলা চালালে তার উপর। নয়ীমকে সিপাহী সুলভ রীতির বাইরে যেতে দেখে সে পুরো তাক দিয়ে তলোয়ার ঘুরিয়ে হামলা করলো তার উপর। নয়ীম তার তলোয়ার দিয়ে এই হামলা প্রতিরোধ করবার চেষ্টা করলো, কিন্তু তলোয়ার তার হাত থেকে কয়েক কদম দূরে ছিটকে পড়লো। নয়ীম পেরেশান হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। মুহম্মদ বিন কাসিম ও ইবনে আমের হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। ইবনে আমের এক হাত শাগরেদের ও অপর হাত নয়ীমের কাঁধে রেখে নয়ীমকে বললেন, ‘এসো, এবার তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।’
‘জি হাঁ, ভাই কোথায়?
ইবনে আমের দ্বিতীয় বালকটির লোহার টুপিটা নামাতে নামাতে বললেন, এদিকে তাকাও।
নয়ীম ভাইজান বলে আব্দুল্লাহকে জড়িয়ে ধরলো। আব্দুল্লাহর অন্তহীন পেরেশানী লক্ষ্য করে মুহম্মদ বিন কাসিম নয়ীমের টুপিটাও খুলে ফেলে বললেন, আব্দুল্লাহ! এ নয়ীম। হায়! এ যদি আমার ভাই হতো!
*
ইবনে আমেরের মতো দক্ষ ওসতাদের যত্নে সাবেরার পুত্রদের আত্মিক, দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিসংক্রান্ত তরী হতে লাগলো অসাধারণ দ্রুতগতিতে। মকতবে আব্দুল্লাহর নাম ছিলো সবার আগে, কিন্তু আখড়ায় নয়ীমের স্থান ছিলো সবার পুরোভাগে। মুহম্মদ বিন কাসিম কখনো আখড়ায় আসতেন এবং তার কোন কোন যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে হতো নয়ীমকে।
মুহম্মদ বিন কাসিমের তেগ চালনার যোগ্যতা ছিলো সবচাইতে বেশী। নেযাহবাষিতে দু’জনের ছিলো সমান দক্ষতা। নয়ীম শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিলো তীরন্দাযীতে। প্রতিক্ষেত্রে সম্মানের অধিকারী হবার মতো গুণরাজি ছেলেবেলা থেকেই বিকাশ লাভ করেছিলো মুহম্মদ বিন কাসিমের মধ্যে। একটা বড়ো কিছু করবার জন্য তিনি পয়দা হয়েছেন বলে তাঁর তারিফ করতেন ইবনে আমের।
আব্দুল্লাহ ও নয়ীমের সাথে মুহম্মদ বিন কাসিমের দোস্তির সম্পর্ক মযবুত হতে লাগলো ক্রমাগত। বাইরে মুহম্মদ বিন কাসিমের নযরে তারা দুজন ছিলো সমান; কিন্তু নয়ীম যে তার বেশী নিকটতর, এ কথা আব্দুল্লাহ নিজে অনুভব করতো। নয়ীমের মকতবে দাখিল হবার পর আট মাস অতীত হলে মুহম্মদ বিন কাসিম শিক্ষা সমাপ্তি পর ফউজে শামিল হলেন।
মুহম্মদ বিন কাসিম চলে যাবার পর নয়ীমের আর একটি গুণের বিকাশ হতে লাগলো মকতবে। মাদ্রাসার ছেলেরা হফতায় একবার করে কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বির্তক সভা করতো নিয়মিত। বিষয়টি নির্ধারণ করে দিতেন ইবনে আমের নিজে। ভাইয়ের দেখাদেখি নয়ীমও এক বির্তক সভায় শরীক হলো। কিন্তু প্রথম বিতর্কে সে কয়েকটা ভাঙা কথা বলে ঘাবড়ে গেলো এবং সলজ্জভাবে মিম্বর থেকে নেমে এলে ছেলেরা বিদ্রূপ করলে ইবনে আমের সান্তনা দিলেন তাকে, কিন্তু সারাদিন তার বিষণ্ণতা কাটলো না। রাতের বেলা সে বারবার পাশ ফিরতে থাকলো ঘুম হারা চোখে। ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে সে চলে গেলো বাইরে। দুপুর পর্যন্ত এক খেজুর গাছের ছায়ায় বসে সে বারংবার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলো তার বক্তৃতা। পরের হকতায় সে আবার গিয়ে হাযির হলো বিতর্ক সভায়। এবর সে এক তেজোময় বক্তৃতা করে অবাক করে দিলো শ্রোতৃবর্গকে। তার দ্বিধাসংকোচ কাটতে লাগলো ক্রমাগত এবং এর পর থেকে সে নিয়মিত শরীক হতে লাগলো প্রত্যেকটি বিতর্কের মজলিসে। বেশির ভাগ বিতর্কে আব্দুল্লাহ ও নয়ীম দু’জনই যোগ দিতো। এক ভাই বিষয়ের সমর্থনে বক্তৃতা করলে অপর ভাই তার বিরোধিতা করতো। শহরের যেসব লোক ছিলো তাদের গুণাগ্রাহী, তারা এবার তাদের বক্তৃতা শুনেও আনন্দ পেতে লাগলো। ইবনে আমের নয়ীমের শিরায় শিরায় কেবল সিপাহীর উষ্ণ রক্তধারাই লক্ষ্য করেননি,বরং তার দীল ও দেমাগে দেখেছেন এক অসামান্য বক্তার উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি। তার এ যোগ্যতার পূর্ণ বিকাশের জন্য তিনি চেষ্টা করতেন যথাসাধ্য। কয়েকটি বক্তৃতার পর সে কেবল মাদ্রাসার শ্রেষ্ঠ বক্তা বলেই স্বকৃতি পেলো না বরং বসরার অলিগলিতে শোনা যেতে লাগলো তার চিত্তাকর্ষক বক্তৃতার তারিফ।