মুজাহিদ। কিশোর সদর্পে জওয়াব দিলো।
‘বেশ ভালো নাম তে! তুমি বেশ বাহাদুর’।
আমার নাম নয়ীম।’
তাহলে তোমার নাম মুজাহিদ নয়?
না আমার নাম নয়ীম।’
‘তুমি কোথায় যাবে?’
মাকিল প্রশ্ন করলো।
ইবনে আমোরর মকতবে। আমার ভাই ওখানে পড়ে?
তারা এখন আখড়ায়। চলো, আমিও যাচ্ছি ওখানে।
নয়ীম মালিকের সাথে চললো। কয়েকটা ছেলে কিছুদূর সাথে এসে ফিরে গেলো। কতকগুলো ছেলে নয়ীমের পেছনে চললো।
নয়ীম তার সাথীকে শুধালো, আখড়ায় তীরন্দাযীও হয় তো?
হাঁ তুমি তীর চালাতে জানো?’
‘হাঁ। উড়ন্ত পাখীকে ফেলে দিতে পারি আমি।’
মালিক পিছু ফিরে নয়ীমের দিকে তাকালো। নয়ীমের চোখ দুটো তখন খুশিতে জলজল করছে।
আখড়ায় বহুলোক আলাদা আলাদা দলে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের তীরন্দাযী, তেগ চালনা ও নেযাহবাযি দেখছে। মালিক সেখানে পৌঁছে নয়ীমকে বললো, তোমার ভাই এখানেই আছে হয়তো। খেলা শেষ হবার আগে তার দেখা পাবে না তুমি.। আপাততঃ এসব তামাশা দেখতে থাক।
নয়ীম বললো, আমি তীরন্দাযী দেখবো।
মালিক তাকে তীরন্দাদের আখড়ার দিকে নিয়ে গেলো। তামাশা দেখতে যারা দাঁড়িয়েছে, তারা দু’জন গিয়ে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলো।
আখড়ার এক কোণে লাগানো রয়েছে একটা কাষ্ঠলক। তার মাঝখানে একটা কালো নিশানা। ছেলেরা পালা করে তার উপর তীর ছুঁড়ছে। তীরন্দাদের কাছ থেকেও শ’খানেক গজ দূরে এই কাঠফলক। নয়ীম বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখলো। বেশির ভাগ তীর গিয়ে লাগছে কালকে, কিন্তু একজন ছাড়া আর কারুর ভীরই কালো নিশানায় লাগলো না।
নয়ীম মালিককে সুধালো, লোকটি কে? এর নিশানা তো ভারী চমৎকার!’
‘উনি হচ্ছেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিম। মালিক জওয়াব দিলো।’
মুহম্মদ বিন কাসিম।
হাঁ, তুমি ওঁকে জানো?
হাঁ, উনি আমার ভাইয়ের দোস্ত। ভাই ওঁর নিশানার বহুত তারিফ করেছেন। কিন্তু এ নিশানায় তো মুশকিল নেই কিছু।’
মুশকিল আবার কোথায়? হয়তো আমিও লাগাতে পারবো এ নিশানা। দেখি, তোমার ধনুকটা দাও তো। হাজ্জাজের ভাতিজা ভাবছেন দুনিয়ায় বুঝি আর তীরন্দাষ নেই।
বলতে বলতে সে নয়ীমের ঘোড়ার যিন থেকে ধনুকটা খুলে নিলো। নয়ীম তৃণীর থেকে একটা তীর দিলো তার হাতে। মালিক এক কদম এগিয়ে গিয়ে নিশানা করলো। লোকগুলো তাকে দেখে হাসতে লাগলো। মালিকের কাঁপা হাতের তীর লক্ষ্যস্থল থেকে কয়েক কদম দূরে মাটিতে গেঁথে রইলো। দর্শকদের তুমুল অট্টহাস্য শোনা গেলো। মালিক লজ্জিত হলো। মুহম্মদ বিন কাসিম হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে তীরটি যমিন থেকে তুলে মালিকের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি আরেকবার চেষ্ট করুন।
মালিক ততোক্ষণে ঘেমে গেছে। সে মুহম্মদ বিন কাসিমের হাত থেকে তীরটি নিয়ে নয়ীমকে এগিয়ে দিল। এবার দর্শকদের নযর পড়লো নয়ীমের উপর। তারা একে একে নয়ীমের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মুহম্মদ বিন কাসিম স্বভাবসুলভ হাসিমুখে নয়ীমের কাছে এসে বললেন, আপনিও একবার দেখুন। দর্শকরা হেসে উঠলো!
তার এ বিদ্রূপ ও দর্শকদের হাসি নয়ীমের বরদাশত হলো না। সে ঝট করে তার নেশাহ নীচে গেড়ে রাখলো এবং ধুনকে তীর যোজনা করে ছুঁড়লো। তীর লক্ষ্যস্থলে গিয়ে নিশানার মাঝখানে লেগে গেলো। মুহূর্ত মধ্যে জনতা নির্বাক হয়ে গেলো এবং পরক্ষণেই জেগে উঠলো এক তুমুল আনন্দধ্বনি।
নয়ীম আর একটি তীর বের করলো তুণীর থেকে। তামাম লোক নিজ নিজ জায়গা ছেড়ে তার চারিদিকে জমা হলো। দ্বিতীয় তীরটিও লাগলো ঠিক লক্ষ্যস্থলে। চারদিক থেকে মারহাবা মারহাবা’ ধ্বনি উঠলো। নয়ীম একবার দৃষ্টি হানলো সমবেত জনতার দিকে। সবারই সপ্রশংস দৃষ্টি নিবদ্ধ তার দিকে। মুহম্মদ বিন কাসিম হাসিমুখে এগিয়ে এসে নয়ীমের হাত নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে বললেন, ‘আপনার নাম কি?
আমায় নয়ীম বলে সবাই জানে।
নয়ীম? নয়ীম বিন…..?”
নয়ীম বিন আব্দুর রহমান।
‘আব্দুল্লাহর ভাই তুমি?
‘জি হাঁ।’
‘এখানে কবে এলে?
এই মাত্র।’
‘আব্দুল্লাহর সাথে দেখা হয়েছে?
‘এখনো হয়নি।’
‘তোমার ভাই হয়তো নেযাহবাযি অথবা তলোয়ার চালোনোর অভ্যাস করছে। তুমি তলোয়ার চালাতে জানো?
‘আমাদের এলাকার একটি লোকের কাছে আমি শিখেছিলাম।
‘তোমার তীরন্দাযী দেখে আমার মনে হয়েছে, তলোয়ার চালাতেও তুমি ভালোই শিখেছো। আজ একটি ছেলের সাথে তোমার মোকাবিলা হবে।’
মোকাবিলার নাম শুনেই নয়ীমের শিরায় যেনো রক্তের গতি দ্রুততর হয়ে উঠলো। সে প্রশ্ন করলো, ছেলেটি কতো বড়ো?
‘তোমার চাইতে খুব বেশী বড়ো নয়। বুঝেসুঝে কাজ করলে জিতে যাওয়া তোমার পক্ষে কষ্টকর হবে না। হাঁ, তোমার তলোয়ারটা খানিকটা ভারী। বৰ্মটাও অনেকটা ঢিলে। আমি এখুনি তার ইনতেম করছি। তুমি ঘোড়া থেকে নেমে এসো।
মুহম্মদ বিন কাসিম একটি লোককে বললেন তার বর্ম, লোহার টুপি ও তলোয়ার নিয়ে আসতে।
*
খানিকক্ষণ পর নয়ীম এক নতুন বর্ম পরিধান করে, হাতে একখানা হালকা তলোয়ার নিয়ে দর্শকদের কাতারে দাঁড়িয়ে আমেরের শাগরেদদের তেগ চালনার কৌশল। তার মাথায় ইউনানী ধরনের টুপি তার মুখ ঢেকে দিয়েছিলো চিবুক পর্যন্ত। তাই যারা তার তীরন্দাযী দেখে তার সাথে এসেছিলো, তার ছাড়া কেউ জানতেই পারেনি যে, সে এক আগমুক।
ইবনে আমের দর্শকদের ভিড় থেকে দূরে ময়দানের মাঝে দাঁড়িয়ে শাগরেদদের হেদায়াত দিচ্ছেন। একটি বালকের মোকাবিলা করবার জন্য পর পর কয়েকটি বালক এসে নামলো ময়দানে কিন্তু কেউ দাঁড়াতে পারলো না তার সামনে। প্রত্যেকটি প্রতিদ্বন্দীকে সে হারিয়ে দিলো কোনো না কোনো রকমে। অবশেষে ইবনে আমের মুহম্মদ বিন কাসিমের দিকে তাকিয়ে, বললেন, মুহম্মদ! তুমি তৈরী হওনি?’ মুহম্মদ বিন কাসিম এগিয়ে এসে ইবনে আমেরকে চাপা গলায় কি যেনো বললেন। ইবনে আমের হাসতে হাসতে নয়ীমের দিকে তাকালেন। আদর করে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি আব্দুল্লাহর ভাই’?