নিকৃষ্টতম দুশমন বলার কারণ, তাঁর যে খুন-পিয়াসী তলোয়ার উন্মুক্ত হতো অনিষ্টকারী ও উচ্ছংখল লোকদের দমিত করবার জন্য, কখনো কখনো তা সীমা ছাড়িয়ে নিষ্পাপ মানুষের গর্দান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতো। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাত যদি মযলুমের খুনে রেঙে না উঠতো, তাহলে ইতিহাসে সে যামানার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তার স্বীকৃতি না পাবার কোনো কারণই থাকতো না। তিনি ছিলেন এমন এক ঘূর্ণিবাত্যার মতো, যা কাটা-ঝাড়ের সাথে সাথে ইসলামের শুলশান থেকে অসংখ্য সুরভী ফুল ও সবুজ শাখাও নিয়েছে উড়িয়ে।
হাজ্জাজের শাসনকালে একদিক ছিলো অন্তহীন বিভীষিকাপূর্ণ; আরেকদিকে ছিলো অন্তহীন দীপ্তিতে সমুজ্জ্বত। তিনি ছিলেন এমন এক ঝড়ের মতো যা সবুজ বৃক্ষরাজিকে সমূলে উৎপাটন করে, করে ভূপতিত, কিন্তু তার কোলে লুকানো মেঘরাজি বারিবর্ষণ করে প্রাণময় সবুজ ওফলপুষ্পে শোভিত করে দেয় হাজারো শুস্ক বাগিচাকে।
আবর মরুভূমির গৃহবিবাদের আসান হলো হিজরী ৭৫ সালে। মুসলমান আবার জেগে উঠলো এক হাতে কুরআন ও অপর হাতে তলোয়ার নিয়ে। তখনকার যামানায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নামের সাথেই উঠতো যায়েদ বিন আমেরের নাম। যায়েদ বিন আমেরের বয়স তখন আশি বছর। ইরানে খসরুর এবং শাম ও ফিলিস্তীনে সিজারের সালতানাত পয়মাল করেছিলো যে শাহসওয়ার বাহিনী, যৌবনে তিনি ছিলেন তাদের সংগী। বার্ধক্যে যখন তার আর তলোয়ার ধরবার ক্ষমতা নেই, তখন ইরানের এক সুবায় তিনি হলেন কাযী। আরবে যখন বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন ইবনে আমের গিয়ে পৌঁছালেন কুফায়। তিনি তাবলীগ করে সেখানকার অবস্থার পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার আওয়ায হলো নিল।
কুফার লোকদের ঔদাসীন্য লক্ষ্য করে ইবনে আমের গেলেন বসরায়। সেখানকার অবস্থাও কুফা থেকে স্বতন্ত্র ছিলো না। ধনী ও দুস্কৃতিকারীরা তার দিকে আমলও দিলো না। নওজোয়ান ও বুড়োদের দিক থেকে হতাশ হয়ে ইবনে আমের তার তামাম উম্মীদ ন্যস্ত করলেন ছোট্ট ছেলেমেয়েদের উপর। তার সবটুকু চেষ্টা, সবটুকু মনোযোগ তিনি নিয়োগ করলেন তাদের শিক্ষাদীক্ষায়। শহরের বাইরে তিনি কায়েম করলেন একটি মাদ্রাসার বুনিয়াদ। বসরায় শান্তি ফিরে এলে সেখানকার বিশিষ্ট লোকেরাইবনে আমেরকে উৎসাহিত করলেন। মাদ্রাসায় শুধু দ্বীনী কিতাবপত্রই পড়ানো হতো না, তাছাড়া আরো শেখানো হতো যুদ্ধ বিদ্যা। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার এ নিঃস্বার্থ খিদমতে মুগ্ধ হয়ে মাদ্রাসার তামাম ব্যয়ভার নিলেন নিজের যিম্মায়। ছাত্রদের রণকৌশল, শাহসওয়ারী প্রভৃতি শিখাবার জন্য উত্তম জাতের ঘোড়া আর নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা হলো এবং ঘোড়ার জন্য তিনি মকতবের কাছেই তৈরী করে দিলেন এক শানদার আস্তাবল।
প্রতি সন্ধ্যায় ছাত্ররা এসে জমা হতো এক প্রশস্ত ময়দানে। সেখানে তাদেরকে ফউজী শিক্ষা দেওয়া হতো হাতে-কলমে। শহরের লোক সন্ধ্যা বেলায় সেই ময়দানের আশেপাশে জমা হয়ে দেখতে ছাত্রদের তেগ চালনা, নেযাহবাযি ও শাহসওয়ারীর নতুন নতুন কায়দা।
মাদ্রাসার সুখ্যাতি শুনে সাঈদ সাবেরাকে চিঠি লিখে পরামর্শ দিলেন আব্দুল্লাহকে সেখানে পাঠাতে। এই নতুন পরিবেশে এসে আব্দুল্লাহর তরী হতে লাগলো দ্রুতগতিতে। তার তরী দেখে তার সহপাঠিদের মনে জাগতো ঈর্ষা। রণকৌশল শিক্ষায়ও সে অধিকার করলো একটি বিশেষ স্থান।
আব্দুল্লাহ বসরায় আসার দু’বছরের মধ্যে পরিচিত হয়ে গেলো সেখানকার ছেলেবুড়ো সবারই কাছে। এই প্রতিভাবান শাগরেদের কৃতিত্ব অজনা ছিলো না ইবনে আমেরের
*
একদিন দুপুর বেলা এক কিশোর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ঢুকলো শহরে। আগন্তকের এক হাতে নেযাহ, অপর হাতে ঘোরার লাগাম। কোমরে ঝুলানো একখানা তলোয়ার। গলায় হেমায়েলও পিঠে ঝুলানো তুণীর। ধনুক বাধা রয়েছে ঘোড়ার যিনের পেছন দিকে। তার তলোয়ার দেহের উচ্চতা অনুপাতে অনেকটা বড়। কিশোর ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে মযবুত হয়ে। প্রত্যেক পথচারী ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে তার দিকে। কেউ তাকে দেখে মৃদু হাসছে, আর কেউ বা হো হো করে। তার সমবয়সী ছেলেরা তামাশা দেখতে জমা হচ্ছে তার আশে পাশে। কিছু সময়ের মধ্যেই তার আগে পিছে এসে জমলো বিস্তর লোক। আগে বরাবর ও পিছু হটবার রাস্তা তারা বন্ধ করে দাঁড়ালো। একটি ছেলে তার দিকে ইশারা করে চীৎকার করে উঠলো বন্ধু’ বলে। আর সবাই তার সাথে চীৎকার করে উঠলো সমস্বরে। অপর একটি বালাক তার দিকে কাঁকর ছুঁড়লো। অমনি আর সব ছেলেরাও শুরু করলো কাঁকর ছুঁড়তে। দলের সরদার ছেলেটি এগিয়ে এসে ছিনিয়ে নিতে চাইলো তার নেই, কিন্তু আগন্তুক নেযাহ ধরে রাখলো মজবুত হাতে। সে ঘোড়ার লাগাম টেনে দ্রুত ঘোড়া চালালো। ঘোড়া ছুটকৃর উপক্রম করলে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলো ছেলেগুলো} আগম্ভক নেহ উদ্যত করে দলের সরদারের পেছনে লাগিয়ে দিলো তার ঘোড়া। তয় পেয়ে সে ছুটে পালালো। আগন্তুক হালকা গতিতে চললো তার পিছু পিছু। বাকী ছেলের ছুটে আসছে পিছু পিছু। মজার কান্ড দেখে কতক বয়স্ক লোকও এসে শামিল হয়েছে ছেলের দলে। আগের ছেলেটির পা একটা কিছুতে লাগলো, অমনি সে পড়ে গেলো উপুড় হয়ে। আগন্তক ঘোড়ার লাগাম টেনে পেছনের ছেলেদের দিকে ফিরে তাকালো এবং কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে গেলো। মালিক বিন ইউসুফ নামে একটি মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এলো দলের ভেতর থেকে। লোকটি বেঁটে, সুগঠিত দেহ। মাথায় মস্ত এক আমামা। তাঁর সামনের দাঁতগুলো খানিকটা উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে, যেনো সে হাসছে। সামনে এগিয়ে এসে সে আগন্তুককে প্রশ্ন করলো, কে তুমি?