মা জওয়াব দিলেন, বেটা, যতোক্ষণ তুমি গোড়ার দিকের শিক্ষা শেষ না করছে, ততোক্ষণ কি করে পাঠাবো? লোকে বলবে, আব্দুল্লাহর ভাই লেখাপড়া জানে না। ঘোড়ায় চড়া আর তীর চালানো ছাড়া জানে না কিছুই। এসব কথা আমি পছন্দ করি না।
মায়ের কথাগুলো নয়ীমের স্পর্শকাতর দীলের উপর ছুরির মতো লাগলো। আঁসু সংবরণ করে সে বললোঃ আম্মি, কেউ আমায় জাহেল বলতে সাহস করবে না। এই বছরই আমি সবগুলো কিতাব শেষ করবো।’
সাবেরা আদর করে নয়ীমের মাথার হাত রেখে বললেন, তোমার পক্ষে কিছুই মুশকিল হবে না বেটা! মুসিবৎ হচ্ছে, তুমি কিছু করতে চাও না।
নিশ্চয়ই করবো আম্মি! আমার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ থাকবে না আপনার।
*
মাহে রমযানের ছুটিতে আব্দুল্লাহ ঘরে ফিরে এলো। তার সারা গায়ে সিপাহীর লেবাস। লোকালয়ের ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে হয়রান। তাকে দেখে নয়ীমের খুশীর অন্ত নেই। উযরা তাকে দূর থেকে দেখে মুষড়ে পড়ে লজ্জায়, সাবেরা বারবার চুমো খান তার পেশানীতে। নয়ীম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আব্দুল্লাহকে তার মাদ্রাসা সম্পর্কে। আব্দুল্লাহ তাকে বলে, সেখানে লেখাপড়ার চাইতে বেশী সময় লাগানো হয় নানারকম রণ-কৌশল শেখাতে। নেযাহবাযি, তেগ চালানো আর তীরন্দাযী শেখানো হয় তাদের মাদ্রাসায়। তীরন্দাযীর কথা শুনে নেচে ওঠে নীমের দীল। ভাইজান! আমায়ও ওখানে নিয়ে চলুল’। অনুনয়ের স্বরে বলে নয়ীম। এখনো তুমি খুবই ছোট। ওখানকার সব ছেলেই তোমার চাইতে অনেক বড়। আরো কিছুকাল তোমায় অপেক্ষা করতে হবে।’ নয়ীম কতক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলো, ভাইজান মাদ্রাসায় আপনি সব ছেলের চাইতে ভালো করছেন না? আব্দুল্লাহ জওয়াব দিলো, না, বসরার একটি ছেলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তার নাম মুহাম্মদ বিন কাসিম। তীরন্দাযী আর নেযাহবাযিতে সে মাদ্রাসার সব ছেলের চাইতেই ভালো। তেগ চালানোয় আমারা দু’জন সমান। কখনো কখনো আমি তোমার কথা তাকে বলেছি। তোমার কথা শুনে সে খুব হাসে।
হাসে?’ নয়ীম উত্তেজিত হয়ে বললো, আমি নিজে গিয়ে তাকে বলে দেবো যে, লোক আমার কথা শুনে হাসবে, তেমনটি আমি নই।
আব্দুল্লাহ নয়ীমের রাগ দেখে তাকে বুকে চেপে ধরে খুশী করবার চেষ্টা করলো।
রাতের বেলায় আব্দুল্লাহ লেবাস বদল করে ঘুমালো। নয়ীম তার কাছে শুয়ে অনেকখানি রাত জেগে কাটালো। ঘুমিয়ে পড়লে সে স্বপ্নে দেখলো, যেনো সে : বসরার মাদ্রাসার ছেলেদের সাথে তীরন্দাষিতে ব্যস্ত। ভোরে সে সবার আগে উঠলো। জলদি করে সে আব্দুল্লাহর উর্দী পরে গিয়ে উযরাকে জাগিয়ে বললো, “দেখো তো উযরা, এ লেবাস আমায় কেমন মানায়?
উযরা উঠে বসলো। নয়ীমের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে সে হেসে বললো, এ লেবাস বেশ মানিয়েছে তোমায়।’
উযরা, আমিও ওখানে যাবো আর এই লেবাস পরে আসবো।’
উযরার মুখের উপর কেমন একটা উদাস ভাব ছেয়ে গেলো। তুমি কবে যাবে ওখানে?’ সে প্রশ্ন করলো।
‘উয়রা, আম্মিজানের কাছ থেকে আমি শীগগিরই এজাযত নেবো।’
চার
৩৫ হিজরী থেকে শুরু করে ৭৫ হিজরী সাল পর্যন্ত সে সময়টা কেটে গেছে, তখনকার ইসলামী ইতিহাস এমন সব রক্ত-রাঙা ঘটনায় ভরপুর, যার আলোচনা। করতে গিয়ে বিগত কয়েক শতাব্দীতে বহু অশ্রুপাত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও আফসোস ও অশ্রুপাত ছাড়া তা স্মরণ করা যাবে না। যে তলোয়ার খোদার নামে নিস্কোষিত হয়েছিলো তা চলতে লাগলো তাদেরই গলায়, যারা খোদার নাম নিচ্ছে। মুসলমান যেমন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার দিকে দিকে, তেমনি দ্রুতগতিতে এ বিপদের প্রসার ঘটলো তাদের মধ্যে। আশংকা হতে লাগলো, যেনো তেমনি দ্রুতবেগে দুনিয়ার সব দিক থেকে সংকুচিত হয়ে তারা সীমাবদ্ধ হবে আরব উপদ্বীপে। কুফা ও বসরা হয়েছিলো তখন নানারকম ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। মুসলামন তাদের প্রারম্ভিক ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে জিহাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন। তাদের সামনে স্বার্থপরতা ও লোভ চরিতার্থ করবার সংগ্রাম এবং ন্যায়-অন্যায় নির্বিশেষে যে কোনো ব্যাপারে কলহ সৃষ্টি ব্যতীত আর কোন দৃষ্টিভংগী ছিলোনা। তখনকার পরিস্থিতিতে এক লৌহ-কঠিন হস্তের প্রয়োজন ছিলো মসুলমানদের এক কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য।
আবর মরুতে হলো এক অগ্নিগিরির উদগীরণ এবং আরব-আযমের ধুমায়মান বিদ্রোহের আগুন সেই অগ্নিগিরির ভয়াবহ শিখার মোকাবিলায় এসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। এই অগ্নিগিরি এক বিরাট ব্যক্তিত্ব হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। প্রচন্ড শক্তিমান হাজ্জাজ, বেরহম যালিম হাজ্জাজ। কিন্তু কুদরৎ আরব মরুর অভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহ খতম করে দিয়ে মুসলমানদের দ্রুতগামী বিজয় অশ্বের গতি পূর্ব ও পশ্চিমের লড়াইয়ের ময়দানের দিকে চালিত করবার মহাকর্তব্য ন্যস্ত করেছিলেন এই মানুষটির উপর।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে যেমন বলা যায় মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, তেমনি বলা যায় নিকৃষ্ঠতম দুশমন। সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু বলা যায় এই কারণে যে, তিনিই এক শান্তিপূর্ণ আবহওয়া পয়দা করে মুসলিম বিজয় বাহিনীর অগ্রগতির জন্য খুলে দিয়েছিলেন তিনটি যুবরদস্ত রাস্তা। এক পথ দিয়ে মুসলিম ফউজ এগিয়ে গেলো ফারগানা ও কাশগড় পর্যন্ত, দ্বিতীয় পত্র মুসলমানদের সৌভাগ্য অশ্ব পৌঁছে গেলো মারাকেশ, স্পেন ও ফ্রান্সের সীমান্তে এবং তৃতীয় পথ ধরে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুষ্টিমেয় সেনা বাহিনী পৌঁছে সিন্ধুর উপকূল ভূমিতে।