না নয়ীম, এ আম্মিজানের হুকুম। তুমি যাও।’
‘আমি যাবো না। আমিও থাকবো এখানেই’।
যাও নয়ীম! আম্মিজান তোমায় মারবেন।’
না, আমি যাবো না।’ নয়ীম আব্দুল্লাহকে জড়িয়ে ধরে বললো।
নয়ীমের পীড়াপীড়িতে আব্দুল্লাহ চুপ করে গেলো।
এদিকে সাবেরার নামায শেষ হলো। মাতৃস্নেহ তিনি আর চেপে রাখতে পারছেন না। ওহ্! কী যালেম আমি! নামায শেষ করেই তিনি গেলেন আস্তাবলের দিকে। নয়ীম মাকে আসতে দেখে পালালো না, বরং ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, “আম্মি! ভাইয়ের কোনো কসুর নেই। আমিই ‘উয’রাকে গভীর পানিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাই শুধু তাকে বাঁচাবার চেষ্টাই করেছে।’
সাবেরা খানিক্ষণ পেরেশান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমারও সেই খেয়ালই ছিলো। আব্দুল্লাহ এদিকে এসো।’ আব্দুল্লাহ উঠে এলে সাবেরা আদর করে কপালে হাত বুলালেন। তারপর তার মাথাটা চেপে ধরলেন বুকের সাথে।
নয়ীমকে আপনি মাফ করুন, আম্মি! আব্দুল্লাহ বললো।
সাবেরা নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেটা! কেন তুমি আগে দোষ স্বীকার করলে না?
‘আমি কি জানতাম ভাইকে আপনি সাজা দেবেন? নয়ীম জওয়াব দিলো। আচ্ছা, তুমি খানা তুলে নাও।’ নয়ীম খানা তুলে নিলো। তারপর তিনজন গিয়ে প্রবেশ করলেন বড়ো কামরায়। তখনো কারুরই কিছু খাওয়া হয়নি, তাই তিনজন আবার একই জায়গায় খেতে বসলেন।
*
ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষাই ছিলো সাবেরার যিন্দেগীর সকল আকর্ষণের কেন্দ্র। স্বামীর মৃত্যুর পর নারী জীবনের যে নিঃসংগতা অনুভূত হয়, তা সত্ত্বেও তাঁর জীর্ণ গৃহখানি একটি আড়ম্বরপূর্ণ শহরের চাইতে কম ছিল না।
রাতের বেলা তিনি যখন এশার নামায শেষ করে অবকাশ পেতেন, আব্দুল্লাহ, উযরা আর নয়ীম তখন তার কাছে বসে জানতো গল্প শোনার দাবী। সাবেরা তাদেরকে শোনাতেন কুফর ও ইসলামের গোড়ার দিকের যুদ্ধের কাহিনী, আর শোনাতেন রসূলে বরহক সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের যিন্দেগীর কিসসা।
ছেলেমেয়েদের নিরুদ্দেশ জীবন বয়ে চলেছে সাবলীল গতিতে। সাবেরার শিক্ষার গুণে তাদের দীলের মধ্যে সিপাহী সুভল গুণের বিকাশ হচ্ছে দিনের দিন। আব্দুল্লাহ বয়সে যেমন বড়ো, নয়ীম ও উযরার তুলনায় তেমনি সে প্রশান্ত গভীর। তেরো বছর বয়সে সে কুরআন পাক ও আরো কতগুলো ছোটখাটো কিতাব পড়ে শেষ করেছে। নয়ীম যেমন বয়সে ছোট, তেমনি খেলাধুলায় তার উৎসাহ বেশি; তাই পড়াশোনায় সে আব্দুল্লাহর পেছেনে রয়েছে। তার চঞ্চল স্বভাব ও দুর্দান্তপনা তামাম লোকালয়ে মশহুর। উঁচু গাছে চড়াতে সে পারে; তেমনি যেতো দুর্দন্ত ঘোড়াই হোক না তার পিঠে সে সওয়ার হয়ে যায় অনায়াসে। ঘোড়ার নাংগা পিঠে চড়তে গিয়ে কতোবার সে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে। প্রত্যেকবার সে উঠে এসেছে হাসিমুখে আর আগের চাইতেও বেশী সাহস নিয়ে মোকাবিলা করেছে বিপদের। এগারো বছরে পা দিতেই তামাম লোকালয়ে তার শাহ-সওয়ারী ও তীরন্দাযির আলোচনা শোনা যায়।
একদিন আব্দুল্লাহ সাবেরার সামনে বসে সবক শুনাচ্ছে। নয়ীম তখন তীর ধনুক হাতে নিয়ে বাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছিলো এদিক ওদিক। সাবেরা আওয়ায দিলেন নয়ীম, এসো এদিকে। আজ তুমি সবক শেখোনি কেন?
যাই আম্মি।
সাবেরা আবার আব্দুল্লাহর দিকে মনোযোগ দিলেন। আচানক এক কাক উড়ে এলো সেদিকে। নয়ীম তীরের নিশানা করলো তখখুনি। কাকটি হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো সাবেরার কাছে। সাবেরা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালেন উপরদিকে। নয়ীম ধনুক হাতে বিজয়গর্বে হাসছে। সাবেরা মুখের হাসি চাপা দিয়ে বললেন, ‘বহুত নালায়েক হয়েছো তুমি!
‘আম্মি, ভাই আজ বলছিলো, আমি নাকি উড়ে যাওয়া পাখীর উপর নিশানা করতে পারি না।’
ভারী বাহাদুর তো হয়েছে! এবার এসে সবক শোনাও।
চৌদ্দ বছর বয়সে আব্দুল্লাহ দ্বীনী এলেম ও যুদ্ধ বিদ্যা শিখবার মতলবে বসরার এক মকতবে দাখিল হবার জন্য বিদায় নিয়ে গেলো। উযরার দুনিয়ার অর্ধেকটা খুশী আর মায়ের মুহব্বত ভরা দীলের একটা টুকরা সে নিয়ে গেলো সাথে করে। আব্দুল্লাহ আর নয়ীম দু’জনের উপরই ছিল উযরার অন্তহীন মহব্বত কিন্ত দু’জনের মধ্যে কার উপর তার আকর্ষণ বেশি? তার নিষ্পাপ দীলের উপর কে বেশী দাগ কেটেছে? তার চোখ কাকে বারবার দেখাবার জন্য বেকারার, আর কার আওয়ায় তার কানের কাছে গুঞ্জন করে যায় সংগীত সুরের মতো?
প্রকাশ্যে উযরা নিজেও এ প্রশ্নের কোনো ফয়সালা করতে পারেনি। তার কাছে আব্দুল্লাহ ও নয়ীম একই দেহের দুটি ভিন্ন নাম। নয়ীমকে বাদ দিয়ে আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে নয়ীমের কল্পনাই তার কাছে অসম্ভর। সে কখনো তাঁর দীলের মধ্যে এদের দু’জনকে তুলনা করে দেখাবার চেষ্টা করেনি। দু’জনাই যখন তার কাছে ছিলো, তখন তাদেরকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবার প্রয়োজনই হয়নি কখনো। দু’জনের কেউ যখন হেসেছে, তখন সে তাতে শরীক হয়েছে। তারা গম্ভীর হলে সেও গম্ভীর হয়ে গেছে।
আব্দুল্লাহ বসরায় হলে যাবার পর এসব প্রশ্ন নিয়ে তার চিন্তা করবার মওকা মিললো। সে জানতো, নয়ীমও সেখানে চলে যাবে কিছুকাল পর। কিন্তু নয়ীমের বিচ্ছেদের চিন্তা তার কাছে আব্দুল্লাহর বিচ্ছেদের চাইতে আরো অসহনীয় মনে হতে লাগলো। আব্দুল্লাহ বয়সে বড়, তার প্রশান্ত গাম্ভীর্য উযরার দীলের মধ্যে মুহব্বতের সাথে শ্রদ্ধার সঞ্চারও করেছিলো। নয়ীমের মতো সেও তাকে ভাইচান বলে ডাকতো এবং তাকে বড় মনে করে তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতো, অবাধে মিশতে পারতো না। নয়ীমের প্রতিও তার শ্রদ্ধার কম ছিল না, কিন্তু তার সাথে আবাধ চলাফেরায় তাদের মধ্যে লজ্জার বাধন ছিলো না। তার দুনিয়ায় আব্দুল্লাহ ছিলো সূর্যের মতো, তার মুগ্ধকর দীপ্তি সত্ত্বেও যেনো তার দিকে তাকানো যায় না চোখ তুলে, তার কাছে, যেতে যেনো ঘাবড়ে যায় মন.। কিন্তু নয়ীমের প্রত্যেকটি কথা যেনো বেরিয়ে আসে তার নিজেরই মুখ থেকে। আব্দুল্লাহ চলে যাবার পর নয়ীমের চালচলনে এলো এক অদ্ভুত পরিবর্তন। আব্দুল্লাহর বিচ্ছেদ নয়ীমের মনে বেশী করে বাজাবে, অথরা সেও একদিন বসরার মাদ্রাসায় দাখিল হবার জন্য অধীর হয়ে রয়েছে, হয়তো এই চিন্তাই তাকে ছেলেবেলার চালচলন থেকে ফিরিয়ে পড়াশোনায় মেনোযোগী করে তুললো। একদিন সে সাবেরাকে শুধালো, আম্মি, আমায় কবে পাঠাবেন বসরায়?