আব্দুল্লাহ তালাব থেকে উঠে এলে নয়ীম ঝট করে ছুটে গেলো অপর কিনারে। সেখান থেকে সে আব্দুল্লাহর কাপড়গুলো নিয়ে এলো। আব্দুল্লাহ কাপড় পরতে পরতে নয়ীমের পানে তার ক্রদ্ধদৃষ্টি হানলো। নয়ীম আগেই হতভম্ব হয়ে গেছে। ভাইয়ের ক্রোধের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে সে কেঁদে ফেললো হু হু করে। আব্দুল্লাহ নয়ীমকে কাঁদতে দেখেছে খুব কম। নয়ীমের চোখের পানি তার মন গলিয়ে দিলো মোমের মতো। সে বললো, তুমি একটা গাধা হয়ে গেছে। ঘরে চলো।
নয়ীম কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, আম্মিজান মারবেন। আমি যাবো না।
মারবেন না।’ আব্দুল্লাহ তাকে সান্তনা দিয়ে বললো।
আব্দুল্লাহর সান্তনা-ভরা কথা শুনে নয়ীমের চোখের পানি শুকিয়ে গেলো। সে এবার চললো ভাইয়ের পিছু পিছু।
রাখাল উযরাকে নিয়ে যখন সাবেরার ঘরে পৌঁছলো, তখন সাবেরার পেরেশানীর আর অন্ত নেই। আশেপাশের মেয়েছেলেরাও জমা হয়েছে সেখানে। বহু চেষ্টার পর উযরা’র হুঁশ ফিরে এলো। সাবেরা রাখালকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এ সব নয়ীমের দুষ্টুমির ফল হবে। উযরাকে ওর সাথে বাইরে পাঠাতে আমি সব সময়ই ভয় করি। পরশুও একটা ছেলের মাথা ফুটো করে দিয়েছে। আচ্ছা, আজ একবার ঘরে এলেই হয়।
রাখাল বললো, এতে নয়ীমের কোন কসুর নেই। সে তো কেবল কিনারে দাঁড়িয়ে ডাক চীৎকার দিচ্ছিলো। তার আওয়ায শুনেই আমি তালাবের কাছে ছুটে এসে দেখি, আপনার বড়ো ছেলে উযরার চুল ধরে টানছে আর সে হাবুডুবু খাচ্ছে।
আব্দুল্লাহ!’ সাবেরা হয়রান হয়ে বললেন, সে তো এমন নয় কখনো? . রাখাল বললো, আজ তো আমিও তার কার্যকলাপ দেখে হয়রান হয়ে গেছি।
আমি সময়মতো না পৌঁছলে নিষ্পাপ মেয়েটি ডুবেই মারা যেতো।
ইতিমধ্যে আব্দুল্লাহ ঘরে পৌঁছলো। নয়ীম তার পিছু পিছু মাথা নীচু করে হাঁটছে। আব্দুল্লাহ সাবেরার মুখোমুখি হলে নয়ীম গিয়ে তার পিছনে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়ালো।
সাবেরা গযবের স্বরে বলে উঠলেন, ‘আব্দুল্লাহ, যাও। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। আমার ধারণা ছিলো, বুঝি তোমার কিছুটা বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে, কিন্তু আজ তুমি নয়ীমেরও চার কদম ছাড়িয়ে গেছে। উযরাকে সাথে নিয়েছিলে ডুবিয়ে মারবার জন্য?
সারা পথ আব্দুল্লাহ নয়ীমকে বাঁচাবার কৌশল চিন্তা করেছে। এই অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনায় সে হয়রান হয়ে গেলো। সে বুঝলো, নয়ীমের কসুর ত্যর ঘাড়েই চেপে বসেছে। সে পিছন ফিরে তাকালো। ছোট্ট ভাইটির চোখে সে দেখতে পেলো এক আকুল আবেদন। তাকে বাঁচাবার একটিমাত্র উপায় আব্দুল্লাহর সামনে। যে অপরাধ সে করেনি, তাই তাকে মাথা পেতে নিতে হবে। ভেবে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়ের ক্রদ্ধ ভর্ৎসনা সে নীরবে হজম করে গেলো।
রাতের বেলা উমরার কাশিসহ জ্বর দেখা দিলো। সাবেরা শিয়রে বসে রয়েছেন। নয়ীমও নেহায়েৎ বিষণ্ণ মুখে তার পাশে বসে। আব্দুল্লাহ ভিতরে ঢুকলো। চুপি চুপি সে গিয়ে দাঁড়ালো সাবেরার পাশে। সাবেরা তার দিকে লক্ষ্য না করে উযরার মাথা টিপে দিচ্ছিলেন। নয়ীম হাত দিয়ে আব্দুল্লাহকে চলে যেতে ইশারা করলো এবং হাত মুঠো করে তাকে বুঝাতে চাইলো যে, এখখুনি তার চলে যাওয়া উচিত, নইলে ফল ভালো হবে না। আব্দুল্লাহ মাথা নেড়ে জওয়াব দিলো যে, সে যাবে না।
নয়ীমকে ইশারা করতে দেখে সাবেরা আব্দুল্লাহর দিকে ন্যর তুললেন। আব্দুল্লাহ মায়ের ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে ঘাবড়ে গেলো। সে বললো, উযরা কেমন আছে?
সাবেরা আগে থেকেই রেগে রয়েছেন। এবার আর সামলাতে পারলেন না।–দাঁড়াও বলছি’-বলে তিনি উঠে আব্দুল্লাহর কান ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। আঙ্গিনার একধারে আস্তাবল। সাবেরা আব্দুল্লাহকে সেদিকে নিয়ে গিয়ে বললেন, উযরা কেন এখনো মরেনি, তাই দেখতে গিয়েছিলে বুঝি? রাতটা এখানেই কাটাও। আব্দুল্লাহকে এই হুকুম দিয়ে সাবেরা গিয়ে আবার উ’রার শিয়রে বসলেন।
নয়ীম যখন খানা খেতে বসলো, তখন ভাইয়ের কথা তার মনে পড়ে গেলো। লোকমা তার গলা দিয়ে সরতে চাইলো না। ভয়ে ভয়ে সে মাকে জিগগেস করলো, ‘আম্মিজান! ভাই কোথায়?
আজ সে আস্তাবলেই থাকবে।’
‘আম্মি, তাকে খানা দিয়ে আসবো?’
না। খবরদার, তার কাছে গেলে…।’
নয়ীম কয়েকবার লোকমা তুললো, কিন্তু তার হাত মুখের কাছে দিয়ে থেমে গেলো।
‘খাচ্ছো না?’ সাবেরা প্রশ্ন করলেন।
‘খাচ্ছি আমি।’ নয়ীম জলদী করে একটি লোকমা মুখে দিয়ে জওয়াব দিলো। সাবেরা এশার নামাযের ওযু করতে উঠলেন। ওযু করে ফিরে এসে নয়ীমকে তেমনি বসে থাকতে দেখে বললেন, নয়ীম, তোমার আজ বড়ড দেরী হচ্ছে। এখনো খানা খেলে না?’
নয়ীম জওয়াবে বললো, আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
বরতনে তখনো খানা পড়ে রয়েছে। সাবেরা তা তুলে অপর কামরায় রেখে নয়ীমকে ঘুমোতে যেতে বললেন। নয়ীম বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সাবেরা নামাযে দাঁড়ালে সে চুপি চুপি উঠে নিঃশব্দে পাশের কামরা থেকে খানা তুলে নিয়ে আস্তাবলের দিকে চললো। আব্দুল্লাহ একটি ঘোড়ার মুখের উপর হাত বুলাচ্ছিলো। দর্য দিয়ে চাঁদের রোশনী এসে পড়েছে তার মুখে। নয়ীম খানা তার সামনে রেখে বললো, আম্মিজান নামায পড়ছেন। জলদী খেয়ে নাও।
আব্দুল্লাহ নয়ীমের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, নিয়ে যাও। আমি খাবো না’।
‘কেন? আমার উপর নারায হয়েছে, না?’ অশ্রুসজল চোখে সে বললো।