তখনই এক রবিবার রাত্রিতে কার্নেগীর ক্লাশে দুশ্চিন্তা দূর করার উপায় নামে যে বইটি পেয়েছিলাম তাই খুলে পড়ি। পড়তে পড়তে উইলিস এইচ. ক্যারিয়ারের চরমের সম্মুখীন হও লেখাটা চোখে পড়ল । তাই নিজেকে প্রশ্ন করলাম সবচেয়ে খারাপ এতে কি হতে পারে, যদি টাকা না দিই আর ব্ল্যাকমেলার সবকিছু ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নীকে জানিয়ে দেয়?
এর উত্তর হলো এই: আমার ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে–সবচেয়ে খারাপ এটাই হতে পারে। তবে প্রচারের ফলে আমার ব্যবসার সর্বনাশ হতে পারে, কিন্তু জেলে যেতে হবে না। আমি তখন নিজেকে বললাম: ঠিক আছে, ব্যবসা উঠে যাবে। এটার জন্য মানসিক ভাবে আমি তৈরি। তারপর?
বেশ, ব্যবসা উঠে গেলে আমায় একটা চাকরী খুঁজতে হবে। সেটা এমন কিছু খারাপ নয়। তেলের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আছে–অনেক প্রতিষ্ঠানই আমাকে পেতে চাইবে। …এবার নিজেকে ভালো বোধ করলাম। তিন দিন তিন রাত যে আতঙ্কে ছিলাম তা থেকে যেন মুক্তি পেলাম …আমার অনুভূতি প্রশমিত হল … আরও আশ্চর্য ব্যাপার, আমি ভাবতে পারলাম।
এবার তৃতীয় ধাপ গ্রহণের ব্যাপারে ভাবতে পারলাম … সবচেয়ে খারাপ অবস্থা থেকে উন্নতি করার প্রয়াস। চিন্তা করতে গিয়ে নতুন একদৃষ্টিকোণ জন্ম নিল । ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নীকে জানালে তিনি হয়তো নুতন কোন বাঁচার পথ বাতলাতে পারবেন। যা আমি ভাবিনি। হয়তো বোকার মতই মনে হবে যে এটা ভাবিনি। তবে চিন্তা তো করতে পারিনি, আমি কেবল দুশ্চিন্তাগ্রস্তই ছিলাম! তাই ঠিক করলাম কাল সকালে প্রথমেই আমার অ্যাটর্নীর সঙ্গে কথা বলবো–এরপর সারারাত একটানা ঘুমোতে পারলাম।
শেষ পর্যন্ত কি হল? আমার অ্যাটর্নী বললেন সব কথা ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নীকে জানাতে, আর আমি ঠিক তাই করলাম। ডিস্ট্রিক অ্যাটর্নী যা বললেন তাতে দারুণ অবাক হয়ে গেলাম। এই ব্ল্যাকমেলের চক্র নাকি অনেক দিন ধরে চলছে, আর সরকারী লোক বলে যে লোকটি পরিচয় দিয়েছে সে এক প্রবঞ্চক, পুলিশ তাকে খুঁজছে। উঃ এসব শুনে কি যে আরাম পেলাম! গত তিন দিন ধরে আমি দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েছিলাম আর জোচ্চর লোকটাকে পাঁচ হাজার ডলার দেবার কথাও ভাবছিলাম।
এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বরাবরের জন্য একটা শিক্ষা পেলাম। যখনই কোন সমস্যা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চেয়েছে তখনই আমি এই পরামর্শ কাজে লাগাবার নাম দিয়েছি উইলিস, এইচ. ক্যারিয়ারের পরামর্শ।
আপনি যদি মনে করেন উইলিস এইচ, ক্যারিয়ারের সমস্যা ছিলো–তাহলে বলি সব শোনেন নি। আর্ল পি. হ্যানের গল্পটা একটু শুনুন, তার বাড়ি হলো ম্যাসাচুসেটুয়ের, উইনচেষ্টারে। ১৯৪৮ সালের ১৭ই নভেম্বর তিনি বোস্টনের একটা হোটেলে আমকে কাহিনীটি শুনিয়েছিলেন।
তিনি শুনিয়েছিলেন, উনিশ শ কুড়ি সালের কাছাকাছি প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা আমায় কুরে কুরে খেয়ে চলেছিল কারণ আমার জঘন্য আলসার হয়। একরাতে প্রচণ্ড রক্তপাত ঘটাল আর আমায় শিকাগোর এক বিখ্যাত হাসপাতালে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার হাত তোলাও বারণ ছিলো। তিনজন ডাক্তার একজন আলসার বিশেষজ্ঞসহ জানিয়ে দিলেন আমার রোগ সারার নয়। আমার খাদ্য হলো কিছু পাউডার আর এক চামচ দুধ এবং ক্রিম। একজন নার্স আমার পেটে নল ঢুকিয়ে সব পরিষ্কার করে দিত।
মাসের পর মাস এরকম চলল …শেষ পর্যন্ত নিজেকে বললাম : শোন হে আর্ল হ্যানি, এইভাবে যন্ত্রণা নিয়ে যদি মরার কথাই শুধু ভাবতে হয় তাহলে যেটুকু সময় আছে তাকে ভালো ভাবে কাজে লাগাও না কেন? তুমি চিরকাল দেশ বিদেশ ঘুরতে চেয়েছে এবার তাহলে সেটাই করে ফেলোনা।
এবার ডাক্তারদের যখন বললাম আমি পৃথিবী ঘুরতে চলেছি আর দিনে দুবার নিজেই পেট পরিষ্কার করব, তারা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অসম্ভব! এরকম কথা তারা জীবনেও শোনেন নি। তাঁরা সাবধান করে বললেন এটা করতে গেলে সমুদ্রেই আমার সমাধি হবে। ‘না তা হবে না!’ আমি বললাম, আমি আমার আত্মীয়দের কথা দিয়েছি পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রেই আমার সমাধি দেওয়া হবে; আর তাই একটা বাক্স সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি একটা কফিনের ব্যবস্থা করে ফেলোম–সেটা জাহাজে নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যবস্থাও করলাম–আমার পথে মৃত্যু হলে তারা আমার দেহটা কফিনে ভরে বরফঘরে রেখে দেশে ফিরিয়ে আনবেন। এবার তাই ওমর খৈয়ামের সেই বিখ্যাত বাণী অবলম্বন করে ভেসে পড়লাম:
মিশবো ধুলোয় তার আগেতে
সময়টুকুর সদ–ব্যাভার ।
স্ফুর্তি করে নাই করি কোন?
দিন কয়েকেই সব কাবার!
যে মুহূর্তে লস এঞ্জেলেসে এস.এস. ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাগমন’ জাহাজে উঠে প্রাচ্যের দিকে যাত্রা করলাম দারুণ ভালো লাগলো। ক্রমে সেই পাউডার খাওয়া আর পেট পরিষ্কার করা ছেড়ে দিলাম। সবরকম খাবারও খেতে লাগলাম–যে সব ওদেশীয় খাবার খাওয়া মানেই আমার মৃত্যু তাও খেতে লাগলাম। কয়েক সপ্তাহ কাটার পর ধূমপানও ধরলাম, সুরাপান ও বাদ দিলাম না। বহুবছর ধরে এমন আনন্দ পাইনি! সমুদ্রে টাইফুন উঠল। শুধু ভয়েই আমার কফিনে ঢোকার কথা–তা না হয়ে বরং ব্যাপারটায় দারুণ উত্তেজনা পেলাম।
জাহাজে খেলাধুলোও করলাম, গান গাইলাম, নতুন বন্ধু জুটলো, রাতও জাগলাম। যখন চীন আর ভারতবর্ষে পৌঁছলাম, দেখতে পেলা দেশে ব্যবসার চিন্তার যা দেখেছি এদেশের দারিদ্রের তুলনায় তা স্বর্গ। আমার সব দুশ্চিন্তা কোথায় মিলিয়ে গেল। চমৎকার বোধ করতে লাগলাম। যখন আমেরিকায় ফিরলাম আমার ওজন নব্বই পাউণ্ড বেড়ে গেছে, আমার কোনকালে পাকস্থলীর আলসার ছিলো তা ভুলেই গেলাম। জীবনে এত ভালো কখনও লাগেনি। ব্যবসায় যোগ দিলাম, তারপর থেকে একদিনের জন্য অসুস্থ হইনি।