আইন পড়ার সময়েও তার অনিদ্রা গেল না। তবু উইন্টারমেয়ার চিন্তা করেন নি। প্রকৃতিই আমার দায়িত্ব নেবে, তিনি বলেছিলেন। হয়েও ছিল ঠিক তাই। অল্প ঘুম সত্ত্বেও তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েনি এবং তিনি হয়ে ওঠেন এক খ্যাতনামা আইনজ্ঞ। তিনি আরও পরিশ্রম করতে থাকেন। কারণ অন্যরা যখন ন্দ্রিা যান তিনি তখন কাজ করতেন।
.
একুশ বছর বয়সেই স্যাম উইন্টারমেয়ার বছরে পঁচাত্তর হাজার ডলার আয় করেছিলেন। কোর্টের এ তরুণ আইনজ্ঞরা তাই তাকে অনুকরণ করার জন্য ছুটেছিলেন। ১৯৩১ সালে তাকে একটামাত্র মামলার জন্য ফি দেওয়া হয় দশ লক্ষ ডলার! একেবারে নগদে! পৃথিবীতে এত টাকা ফি আর কাউকেই কেউ দেয়নি।
কিন্তু তাঁর অনিদ্রা সারেনি–মাঝরাতে পর্যন্ত তিনি পড়ন–তারপর ভোর পাঁচটায় উঠে চিঠি লিখতেন। মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠত তাঁর কাজ ততক্ষণে অর্ধেকটাই শেষ । তিনি একাশি বছর বেঁচেছিলেন। আশ্চর্য কথা এমন মানুষ, যিনি সারা জীবন প্রায় অনিদ্রায় কাটান। অথচ তিনি যদি এই অনিদ্রা সম্পর্কে ভাবনায় ভেঙে পড়তেন তাহলে নিঃসন্দেহে নিজের জীবন শেষ করে ফেলতেন। আমরা জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটাই–অথচ অনেকেই জানি না ঘুম কাকে বলে । আমরা জানি এ হল একটা অভ্যাস আর বিশ্রামের অবস্থা যাতে প্রকৃতি আমাদের এই বিশ্রামের সময় যত্ন করেন। কিন্তু আমরা জানি একজন লোকের কত ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন বা সত্যিই ঘুম চাই কি না।
অবিশ্বাস্য? তা হলে শুনুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পল কার্ন নামে এক হাঙ্গেরীর সৈন্যের মস্তিস্কের সামনের দিকে গুলি লাগে। আঘাত থেকে তিনি রক্ষা পান। তবে আশ্চর্যের কথা তিনি অনিদ্রার শিকার হন। ডাক্তাররা সবরকম চেষ্টা করেন–সব রকম ওষুধ দেওয়া হয়–কিন্তু ফল একটাই কার্নের ঘুম আনানো সম্ভব হয়নি।
ডাক্তাররা জানালেন কার্ন বেশিদিন বাঁচবে না। কিন্তু সে তাদের বোকা বানাল। সে একটা কাজ পেল আর তার ফলে স্বাস্থ্য বেশ ভালো হয়ে উঠল। সে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে থাকলেও তার ঘুম আসতো না। তার ব্যাপারটা ডাক্তারী শাস্ত্রের এক রহস্য এবং ঘুম সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত ধারণাই পাল্টে দিয়েছে।
কারও কারও অন্যদের চেয়ে বেশি ঘুম দরকার। টসকানিনির দরকার হত মাত্র পাঁচ ঘন্টা, অথচ ক্যালভিন কুলিজের দ্বিগুন লাগত। কুলিজ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এগারো ঘন্টাই ঘুমোতেন। অর্থাৎ টসকানিনি তার জীবনের এক পঞ্চমাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন আর কুলিজ জীবনের অর্ধেকটাই।
অনিদ্রার চেয়ে অনিদ্রার চিন্তাই আপনার ক্ষতি করে বেশি। উদাহরণ হিসেবে আমার এক ছাত্রী ইরা স্যাণ্ডনারের কথাই বলি : ধারাবাহিক অন্দ্রিার জন্য ইরা প্রায় আত্মহত্যা করতে চলেছিল।
ইরা স্যাণ্ডনার আমায় জানায়, আমি ভেবেছিলাম আমি পাগল হয়ে যাব। গোলমাল শুরু হয় গোড়ায় যখন আমি গাঢ় ভাবেই ঘুমোতাম–এমন কি অ্যালার্ম ঘড়ি বাজলেও আমার ঘুম ভাঙতো না। ফলে সকালে কাজে দেরী হয়ে যেত। আমার অফিসের মালিক জানালেন দেরী করলে চাকরি রাখা দায় হবে। আমি জানতাম আমি বেশি ঘুমোই।
এক বন্ধু আমায় জানালো অ্যালার্ম ঘড়ির কথাটাই যেন বেশি করে ভাবি। এতেই অনিদ্রার সূচনা হল। অ্যালার্ম ঘড়ির যাচ্ছেতাই টিকটিক শব্দ আমার মাথা খারাপ করেছিল। তাতেই সারা রাত জেগে থাকতাম । আট সপ্তাহ এই রকম চলল। কি কষ্ট পেয়েছি বলে বোঝাতে পারব না। আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম পাগল হয়ে যাচ্ছি। কখনও কখনও মেঝের উপর ঘন্টার পর ঘন্টা পায়চারি করতাম আর জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ব ভাবতাম!
শেষ পর্যন্ত একজন পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ইরা আমি তোমায় সাহায্য করতে পারব না। কেউই পারবে না, কারণ এটা তুমি নিজেই সৃষ্টি করেছো। রোজ রাত্রে শুতে যাবে আর ঘম আসছে কিনা আসছে তা আদৌ ভাববে না। শুধু নিজেকে বলবে; ঘুম না এলেও গ্রাহ্য করি না। সকাল পর্যন্ত জেগে থাকলেও কিছুই হবে না। শুধু চোখ বন্ধ করে বলবে : যতক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকবো তখন কোন দুশ্চিন্তা করব না– আমি ঘুম চাই না, চাই বিশ্রাম।
স্যাণ্ডনার বলেছিল, আমি তাই করলাম আর দু সপ্তাহের মধ্যেই আবার ঘুমোতে লাগলাম। একমাসের মধ্যেই আট ঘন্টা ঘুমোতে লাগলাম আর স্বাভাবিক হয়েও উঠলাম।
ইরা স্যাণ্ডনার অনিদ্রার জন্য কষ্ট পায়নি। মেয়েটি কষ্ট পায় দুশ্চিন্তা করে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডও নাথানিয়েল ক্লিটম্যান মানুষের ঘুম নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন। বিশ্বে তিনি বিখ্যাত একজন নিদা বিশেষজ্ঞ। তিনি স্বীকার করেছেন অনিদ্রায় মারা গেছেন এমন কারও কথা তার জানা নেই। তিনি বলেছেন দুশ্চিন্তাই মানুষকে কুরে কুরে খায় এবং শরীরকে দুর্বল করে ফেলে।
উদাহরণ হিসেবে বলছি, উনিশ শতকের নামি চিন্তাবিদ হার্বাট স্পেন্সার একটা বোর্ডিং এ থাকতেন এবং বকবকানিতে সবাইকে পাগল করতেন তার অনিদ্রার কথা বলে। তিনি কানে ছিপি এটে শব্দ বন্ধ করে স্নায় শান্ত রাখতেন। একরাতে তার সঙ্গে শুয়েছিলেন অক্সফোর্ডের প্রফেসর সেইশ। পরদিন স্পেন্সার জানালেন যে সারারাত তিনি ঘুমোননি। আসলে প্রফেসর সেইশ স্পেন্সরের নাক ডাকার শব্দে ঘুমোতে পারেন নি।
রাতে ভালো ঘুমোনোর জন্য প্রথম দরকার নিরাপত্তাবোধ। আমাদের মনে করতে হবে আমাদের চেয়ে বৃহত্তম কোন শক্তিই সকাল পর্যন্ত আমাদের দায়িত্ব নেবে। ড. টমাস হিসলপ ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক বলেছেন, যা দেখেছি তাতে ঘুম আসার সবচেয়ে ভালো উপায় হল–প্রার্থনা। আমি একজন চিকিৎসক হিসেবেই এটা বলছি। তিনি সবসময় প্রার্থনার দ্বারা নিরাপত্তাবোধ করতেন। সে সময় তিনি বাইবেল থেকে এই প্রার্থনাটি করতেন–স্বয়ং ঈশ্বরই আমার মেষপালক, আমি আর কিছুই চাই না।