কিন্তু এসব কথা জেনে লাভ কি? আপনার এতে করার আছেই বা কি? একজন স্টেনোগ্রাফারের কথা বলছি–অকলাহোমার টুলসার এই স্টেনোগ্রাফার কি করেছিল শুনুন। তাকে সারা মাস ধরেই একঘেয়েমিভরা কাজ করে চলতে হতো। তার কাজ ছিল কাগজপত্র গোছানো, চিঠিপত্র তৈরি রাখা, এই সব। অত্যন্ত একঘেয়ে কাজ বলে সে একদিন নিজে বাচার জন্যেই কাজটা একটু আনন্দময় করবে বলে ভেবে নিল। নিজে নিজেই সে একটা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে ফেললো। প্রতিদিন সকালে কতগুলো ফর্ম সে তৈরি করতো এবং সেগুলো গুণে রাখতে আরম্ভ করলো। তারপর সেই সংখ্যা বিকেলের দিকে যাতে অতিক্রম করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হল। সে প্রতিদিনের কাজের হিসেব রেখে পরদিন সেটা। পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে আরম্ভ করল। এর ফল কেমন হয়েছিল? সে অল্প কদিনের মধ্যেই ওর দপ্তরের বাকি স্টেনোগ্রাফারের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ফেলতে লাগলো। কিন্তু তাতে তার কি হলো? সে প্রশংসা লাভ করলো, না…ধন্যবাদ পেলো? না,…পদোন্নতি ঘটলো? না।…মাইনে বাড়লো? তাও না …তবে এর ফলে তার অবসাদের ভাব কেটে গেলো। সে পেলো সেই একঘেয়েমি ভরা কাজ থেকে মানসিক আনন্দ এবং আরও শক্তি, আনন্দ আর অবসর যাপনের সুখ।
গল্পটা যে সত্যি সেটা আমার জানা, কারণ ওই মেয়েটিকেই আমি বিয়ে করেছি।
আরও একজন স্টেনোগ্রাফারের গল্প শোনাচ্ছি। তিনিও একঘেঁয়েমি ভরা কাজকে আনন্দময় করতে চেষ্টা চালিয়ে সফল হন। তিনি আমাকে নিজের কাহিনী লিখে জানিয়ে ছিলেন। সেটা তার নিজের ভাষাতেই বলছি :
আমাদের অফিসে স্টেনোগ্রাফারের সংখ্যা হলো চারজন। চারজন নানাজনের চিঠিপত্র দেখাশোনা করে। আমাদের কাজের চাপে মাঝে মাঝে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। একবার একজন সহকারী অধিকর্তা আমাকে একটা বড় চিঠি টাইপ করার কথা বলেন। আমি আপত্তি জানিয়ে বলি কয়েকটা কথা শুধরে নিলেই কাজ চলতে পারে। নতুন করে টাইপ করতে হবে না। ভদ্রলোক আমাকে দু কথা শুনিয়ে। জানালেন আমার ইচ্ছে না থাকলে অন্য কাউকে দিয়েই তিনি টাইপ করিয়ে নেবেন। প্রচণ্ড রাগ করেই। আমি চিঠিটা নিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার জায়গায় থেকে কাজ করতে পারলে অনেকেই ধন্য হতো। তাছাড়া ঠিক এই রকম কাজ করার জন্যেই আমাকে মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে। এরপরেই ভালো। বোধ করতে লাগলাম। আচমকা মন ঠিক করে ফেলোম, যেন ভালো লাগে এমন মনোভাব নিয়ে এবার থেকে কাজ করবো–যদিও মনে মনে আমার ঘৃণাই হতো। তারপরেই আমি এই দারুণ দরকারী জিনিস আবিষ্কার করে বসলাম। আমি যদি কাজটা ভালোবাসি মনে করে কাজ করে যাই, তাহলে কিছুটা ভালো করে কাজ করতে পারবো। অতএব আমায় কদাচিৎ বাড়তি কাজ করার দরকার হতো। আমার এই নতুন পদ্ধতির ফলে ভালো কর্মচারী হিসেবে আমার সুনাম হলো। এরপর যখন একজন বিভাগীয় সুপারিন্টেডেন্টের একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির দরকার হলো তিনি আমাকেই চাইলেন, কারণ তাঁর মতে। আমি অসন্তুষ্ট না হয়ে বাড়তি কাজ করতে চাই এবং ঠিক এমনটাই তার দরকার। এই ভাবে শুধু মানসিক চিন্তাধারা বদলের ফলেই দারুণ কিছু ঘটে গেলো। এ এক দারুণ আবিষ্কার। অদ্ভুত কিছুই এতে ঘটেছে।
ক’বছর আগে হারল্যান এ. হাওয়ার্ড এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাতে তার জীবন ধারাই সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তিনি নীরস একটা কাজকে সরস করতে চেষ্টা করেন। সত্যিই তার কাজটা একঘেয়েমিতে ভরা ছিলো–প্লেট সাফ করা, কাউন্টার ধোলাই করা, উঁচু ক্লাসের খাওয়ার ঘরে আইসক্রিম সরবরাহ করা ইত্যাদি যখন করত, তখন অন্য ছেলেরা খেলাধূলোয় বা মেয়েদের সঙ্গে খুনসুটি করতে ব্যস্ত। হারল্যান হাওয়ার্ড মনে প্রাণেই তার কাজকে ঘৃণা করত। কিন্তু কাজটা যখন তাকে করে যেতেই হবে, তখন সে আইসক্রীম কি দিয়ে তৈরী সেটা জানবে বলে ঠিক করে ফেলল। তাছাড়া একটা আইসক্রীম আর একটার চেয়ে কেনই বা ভালো। সে আইসক্রীমের রসায়ন পড়তে আরম্ভ করল আর পরে দক্ষতাও অর্জন করলো। খাদ্য রসায়ন সম্পর্কে তার আগ্রহ এতই বেড়ে উঠল যে শেষপর্যন্ত সে ম্যাসাচুসেটস্ স্টেট কলেজে ভর্তি হলো। এরপর যখন নিউইয়র্ক কোকো এক্সচেঞ্জ, কোকো আর চকলেট সম্বন্ধে একশ ডলার পুরস্কার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলে কলেজ ছাত্রদের জন্য–কে জয়ী হল জানেন? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। হারল্যান হাওয়ার্ড।
কাজকর্ম জোগাড় করতে না পেরে সে তার বাড়ি ম্যাসাচুসেটসের আমহাস্টের ৭৫দ্ম নর্থ প্লেজান্ট স্ট্রীটে একটা ছোট্ট গবেষণাগার খুললো। কিছুদিনের মধ্যে দেশে একটা নতুন আইন চালু হলো যে দুধের মধ্যেকার বীজানু গুনতে হবে। হারল্যান হাওয়ার্ডকে কিছুদিনের মধ্যেই আমহার্স্টের অন্তত কুড়িটা প্রতিষ্ঠানের দুধের বীজানু গোনার কাজে দেখা গেল। তাকে দুজন সহকারীও রাখতে হলো।
পঁচিশ বছর পরে এই ছেলেটির কি হবে জানেন? এখন যারা ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছেন সেই সব মানুষ ততদিনে অবসর নেবেন বা হয়তো পরলোকে যাবেন, আর তাদের স্থান নেবেন আজকের হাস্যোজ্জ্বল করিকর্মা তরুণ ছেলেরাই। পঁচিশ বছর পরে আজকের হারল্যান হাওয়ার্ড হয়ে উঠবে তার পেশায় একজন অতি বিখ্যাত মানুষ, অন্য দিকে তার সহপাঠিরা, যাদের সে আইসক্রীম বিক্রী করতো তারা হয়তো বেকার থেকে সরকারকে অভিসম্পাত দিয়ে চলবে। হারল্যান এ, হাওয়ার্ড হয়তো কোন সুযোগ পেত না যদি না সে একটা একঘেয়েমি ভরা কাজকে আনন্দময় করে তুলতে চাইত।