তাহলে কি আট ঘন্টা আগে এলিস ক্লান্ত ছিলো না? নিশ্চয়ই ছিল। সে অবসাদে ভেঙে পড়েছিলো কারণ নিজের কাজে ওর একঘেঁয়েমি এসেছিল। এরকম আরও এলিসকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনিও একজন হতে পারেন।
আর এটা সত্য যে আপনার আবেগজনিত মনোভাবই শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে অবসাদ সৃষ্টির জন্য বেশি . দায়ী। কয়েক বছর আগে জোসেফ ই. বারম্যাক আর্কাইভস অব সাইকোলজি–তে এক প্রবন্ধে বুঝিয়েছিলেন একঘেঁয়েমি কেমন করে অবসাদ সৃষ্টি করে। একটা পরীক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি এটা জানান। ডঃ বারম্যাক কিছু ছাত্রকে কোন এক পরীক্ষার কাজে লাগিয়েছিলেন যেটায় তিনি জানতেন তাদের কণামাত্রও আগ্রহ ছিল না। ফলাফল কি হলো? ছাত্ররা অভিযোগ করলো তারা অবসাদগ্রস্ত, মাথার যন্ত্রণায় আক্রান্ত, চোখ টাটানিতে বিরক্ত আর তাদের ঘুম পাচ্ছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পেটেরও গণ্ডগোল হয়। সবটাই কি কল্পিত? না। বিপাকীয় পরীক্ষায় দেখা যায় যে শরীরে রক্তের চাপ আর অক্সিজেন গ্রহণ কোন মানুষ একঘেয়ে বোধ করলেই কমতে থাকে। অথচ সে কাজে আগ্রহ আর আনন্দ বোধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিপাকীয় ক্রিয়া বেড়ে যায়।
আমরা যখন পছন্দসই আর উত্তেজনাময় কাজ করি তখন কদাচিত আমরা অবসাদগ্রস্ত হই। উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আমি কিছুদিন আগে কানাডিয়ান রকি পর্বত এলাকার লুইজি হ্রদ অঞ্চলে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কিছুদিন আমি প্রবাল খাড়ি বরাবর মাছ ধরেছিলাম। এই আনন্দ করতে গিয়ে আমার মাথার চেয়েও উঁচু সব ঝোঁপের মধ্য দিয়ে পথ করে চলেছি, গাছের গুঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়েছি–অথচ আট ঘন্টার টানা পরিশ্রম করার পরেও এতটুকুও ক্লান্ত হইনি। এমন হওয়ার কারণ কি? কারণ হলো উত্তেজনা আর দারুণ আনন্দে ছিলাম। দারুণ কাজ করেছি বলে আমি ভাবছিলাম। মস্ত আকারের ছ’টা ট্রাউট মাছ ধরেছিলাম। ধরুন যদি মাছ ধরতে ধরতে আমার একঘেয়েমি আসতো, তাহলে আমার মনোভাব কেমন হতো? তাহলে এমন পরিশ্রমের পর সাত হাজার ফিটের উপর আমায় অবশ্যই অবসাদে ভেঙে পড়তে হতো।
পাহাড়ে চড়ার মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজে একঘেয়েমিই পরিশ্রমের চেয়ে ঢের বেশি অবসাদগ্রস্ত করে দেয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি : মিনিয়াপোলিশের মিঃ এস. এইচ. কিংম্যান ব্যাপারটা আমায় জানান। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে কানাডা সরকার কানাডা আলপাইন ক্লাবকে প্রিন্স অব ওয়েলস রেঞ্জার্সের কিছু সৈন্যকে পর্বতারোহণ শেখানোর জন্য কিছু পথপ্রদর্শক দিতে অনুরোধ জানায়। মি কিংম্যান ছিলেন ঐ সৈন্যদের পর্বতরোহণ শেখানোর একজন শিক্ষক আর গাইড। তিনি আমায় বলেছিলেন ওই সব গাইডদের বয়স ছিল বিয়াল্লিশ থেকে ঊনষাট বছর–তারা ওই সব তরুণ সৈন্যদের হিমবাহ আর তুষার স্কুপের উপর দিয়ে প্রায় চল্লিশ ফুট খাড়া চুড়োতেও নিয়ে যান। সেখানে তাদের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পথে যেতে হয়, কোন রকমে পা রাখা যায় এমন পথেও উঠতে হয়। তারা কানাডিয়ান রকি পর্বতের উচ্চ শিখরে তার নাম করণ হয়নি এমন সব শিখরেও ওঠেন। কিন্তু পনেরো ঘন্টা ধরে এই পর্বতারোহণের পর স্বাস্থ্যবান তরুণ সৈন্যরা (যারা প্রায় ছ’মাস কঠিন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করেছিলো) প্রায় অবসাদে ভেঙে পড়ে।
ওদের ওই অবসাদ কি আগেকার কঠিন শিক্ষায় মজবুত না হয়ে ওঠা পেশীর জন্য? যারা কমাণ্ডো ট্রেনিং গ্রহণ করেছেন তারা কথাটা শুনে হেসে উঠবেন! না, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হয়েছিল পাহাড়ে চড়ার একঘেয়েমির জন্য। তাদের কেউ কেউ এমনই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে খাবার জন্য অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের পথপ্রদর্শকরা যারা সৈন্যদের চেয়ে বয়সে দুই বা তিনগুণ বড়–তারাও কি ক্লান্ত হয়? হ্যাঁ, তারা ক্লান্ত হলেও ভেঙে পড়েনি। তারা নৈশভোজ সেরে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পগুজব করে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করে চলেছিলো। তারা ভেঙে পড়েনি কারণ তাদের আগ্রহ ছিলো।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড ব্রডওয়ার্ড থাইক অবসাদ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় কিছু তরুণকে প্রায় এক সপ্তাহ ঘুমোতে দেননি নানা উৎসাহজনক কাজে ব্যস্ত রেখে। নানা রকম পরীক্ষার পর তিনি ঘোষণা। করেন : একঘেয়েমিই হলো কাজে উৎসাহ কমে আসার কারণ।
আপনি যদি মানসিক পরিশ্রম করে থাকেন তাহলে আপনার কাজের পরিমাণ আপনাকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে না। যে কাজ আপনি করেন না তাই আপনাকে ক্লান্ত অবসাদময় করে তুলতে পারে। যেমন ধরুন, গতসপ্তাহে কথাটাই, সে সময় আপনি হয়তো বারবার বাধাপ্রাপ্ত হন। কোনো কাজ শেষ হয়নি, চিঠির জবাব দেওয়া হয় নি, সাক্ষাৎকার করা যায়নি। সবই কেমন গোলমেলে হয়ে যায়। কিন্তু আপনি সেদিন কিছু না করেও বাড়ি ফিরলেন ক্লান্ত হয়ে মাথায় যথেষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে।
অথচ পরের দিন অফিসে সবই চমৎকার কাজকর্ম হয়। আগেকার চল্লিশগুণ বেশি কাজ করেন। আপনি। তা সত্বেও ঝকঝকে সাদা টাটকা গার্ডেনিয়া ফুলের মতো হয়েই বাড়ি ফিরলেন। আপনার এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হয়েছে। হয়েছে আমারও।
এ থেকে কি শিক্ষা পাচ্ছি আমরা? এই শিক্ষা যে, আমাদের অবসাদ আসে কাজের জন্য নয় বরং ভাবনা চিন্তা হতাশ আর বিরক্তি থেকে।
এই পরিচ্ছেদ লেখার সময় আমি জেরোম কার্ণের সঙ্গীত বহুল ‘শো বোট’ নাটকটি দেখতে গিয়েছিলাম। নাটকের নায়কের মুখে শোনা যায় : একমাত্র ভাগ্যবান তারাই যারা কাজ করে আনন্দ পায়। এরকম মানুষেরা ভাগ্যবান এই জন্যই যে তাদের রয়েছে অনেক বেশি ক্ষমতা, কম উদ্বেগ আর কম অবসাদ।