আপনি বা আমি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি দুই অসীমের সন্ধিক্ষণে–যে বিশাল অতীত চিরকাল রয়ে গেছে আর যে আগামী ভবিষ্যৎ চিরকাল থাকবে। আমরা এ দুই কালের কোনটাতেই সম্ভবত থাকতে পারি না–না, এক মুহূর্তও না। এরকমভাবে থাকতে গেলে আমাদের শরীর আর মন শেষ হয়ে যাবে। তাই যা থাকা সম্ভব তাই থাকি আসুন–এখন থেকে ঘুমোনোর সময় পর্যন্ত। রবার্ট লুই স্টিভেনসন বলেছেন, যত কঠিন ভারই হোক মানুষ রাত অবধি তার বোঝা বইতে পারে। যে–কোনো লোকই যত কঠিন হোক তার কাজ করতে পারে একদিনের জন্য। যে কোন মানুষ আনন্দে, ধৈর্য নিয়ে, সুন্দরভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর জীবনের অর্থই তাই।
হ্যাঁ, জীবনে এর বেশি আর কিই বা প্রয়োজন। তবে মিচিগানের মিসেস ই.কে. শিল্ডস হতাশায় প্রায় আত্মহত্যাই করে বসেছিলেন যতদিন না তিনিও ঘুমনো পর্যন্ত বেঁচে থাকার কৌশল আয়ত্ব করেন। মিসেস শিল্ডস আমায় বলেন, ১৯৩৭ সালে আমার স্বামী মারা যান। আমি হতাশায় ভেঙে পড়ি–একেবারে কপর্দক শূন্য ছিলাম আমি। আমার পূর্বতন নিযোগকর্তা মি. লিও রোচকে লিখে পুরনো কাজটা ফিরে পাই। আগে শহরে আর গ্রামের স্কুলে ওয়ার্লড বুকস এর বই বিক্রি করতাম। স্বামীর সুখের সময় দুবছর আগে আমার গাড়িটা বেচে দিই, সামান্য টাকা জমিয়ে একটা পুরনো গাড়ি কিনে বই বিক্রি শুরু করলাম।
ভেবেছিলাম রাস্তায় বের হলে আমার হতাশা কাটবে। কিন্তু একাকী গাড়ি চালিয়ে আর একা একা খেতে গিয়ে আমার অসহ্যবোধ হল। কোথাও কিছুই বিক্রি হত না, গাড়ির কিস্তির টাকা কম হলেও তা শোধ দিতে পারিনি।
১৯৩৮ সালের বসন্তকালে মিসৌরির ভার্সাইতে আমি কাজ করছিলাম। স্কুলগুলো বড় গরিব ছিল, আমিও একাকীবোধ করতাম, রাস্তাও বড় খারাপ। হতাশায় প্রায় আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিলাম। সাফল্য অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সবেতেই আমার ভয় ছিল, ভাবছিলাম গাড়ির টাকা দিতে পারব না, ঘরের ভাড়া হবে, খাওয়া জুটবে না, ডাক্তারের পয়সাও ছিল না। আত্মহত্যায় প্রয়াসী হই নি আমার বোন কষ্ট পাবে বলে আর অন্ত্যেষ্টির জন্য এক কপর্দকও ছিল না বলে।
তারপর একটা প্রবন্ধ পড়ার পরই আমি হতাশা ভুলে বাঁচার সাহস পেলাম। প্রবন্ধের একটা কথার জন্য আমি চিরঋণী হয়ে রইলাম। কথাটি এই : বুদ্ধিমান মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই নতুন জীবন। কথাটি টাইপ করে আমার গাড়ির সামনের কাঁচে লাগিয়ে রাখলাম, গাড়ি চালানোর প্রতি মুহূর্তেই তা নজরে পড়ত। আমি রাখলাম, গাড়ি চালানোর প্রতি মুহূর্তেই তা নজরে পড়ত। আমি দেখলাম প্রতিদিন বেঁচে থাকা কঠিন নয়। আমি গতকাল আর আগামীকালের কথা ভুলে গিয়ে তার কৌশল আয়ত্ব করলাম। প্রতিদিন সকালে নিজেকে বলতাম, আজ এক নতুন জীবন।
আমি একাকীত্বের আর অভাবের ভয় কাটিয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম। আজ আমি সুখী আর বেশ সফল, জীবন সম্পর্কে আমার নতুন আগ্রহ জেগেছে। আমি জানি আর কখনই আমি ভয় পাবো না, জীবনে যে সমস্যাই আসুক না কেন। আমি জানি ভবিষ্যৎকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই–আমি জানি আমি এখন প্রতিদিনের জন্য বাঁচতে পারি–আর প্রতিটি দিনই জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে এক নতুন জীবন।
নিচের কবিতাটি কার লেখা বলতে পারেন?
সেই মানুষই সবার চেয়ে সুখী,
যিনি আজকের দিনকে নিজের বলতে পারেন,
তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি বলেন :
আগামীর বিপদকে ভয় করি না কারণ আমি আজ বেঁচেছি।
কবিতাটি আধুনিক মনে হচ্ছে? তবুও বলি এই কবিতা যীশুর জন্মেরও ত্রিশ বছর আগে লিখেছিলেন রোমান কবি হোরেস।
মানবচরিত্র সম্পর্কে আমার সবচেয়ে দুঃখজনক যে কথা জানা আছে তাহল আমরা সকলেই জীবনযুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাই। আমরা সবাই দিগন্তপারের কোন মায়া গোলাপের স্বপ্নে আচ্ছন্ন। কিন্তু জানালার পাশে যে অসংখ্য গোলাপ ফুটে রয়েছে তা আমরা দেখি না।
আমরা এরকম বোকামির কাজ করি কেন?
স্টিফেন লিকক লিখেছিলেন, আমাদের জীবনের ছোট্ট শোভাযাত্রা কী অদ্ভুত! শিশু ভাবে আমি যখন বড় হব। কিন্তু বড় হবার পর সে বলে আমি যখন আরও বড় হব। বড় হয়ে সে বলে, যখন আমি বিয়ে করব। কিন্তু বিয়ে করার পর কী হল? চিন্তাটা দাঁড়াল আমি যখন অবসর নেব। কিন্তু অবসর নেবার পর সে পিছনে তাকালে দেখে অতীতের দৃশ্য–একটা শীতল পরশ যেন বয়ে যায়–সবই সে উপভোগে বঞ্চিত হয়েছে। আমরা ভুলে যাই এ জীবন উপভোগের জন্যই প্রতিদিন, প্রত্যেক মুহূর্ত তাকে উপভোগ করতে হয়।
ডেট্রয়টের প্রয়াত এডওয়ার্ড ই. ইভান্স দুশ্চিন্তায় প্রায় আত্মহত্যা করতে যান, কিন্তু যেদিন তিনি বুঝতে পারলেন বেঁচে থাকাতেই জীবনের আনন্দ প্রতিটি মুহূর্তে তখনই তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। দারিদ্রের মধ্যে তিনি মানুষ হন, অর্থ রোজগার করেন প্রথম সংবাদপত্র বিক্রি করে, এমনকি মুদির দোকানেও কাজ করেন। সাতজনের পরিবারে রুটি জোগানোর দায়িত্ব নিয়ে সহকারী গ্রন্থাগারিকের কাজ নেন। সামান্য মাইনে ছিল তার তবু কাজটা ভয়ে ছাড়তে পারতেন না। আট বছর কাটার পর তিনি সাহস সঞ্চয় করে নিজে কিছু করবার চেষ্টা করেন। তারপর ধার করে মাত্র পঞ্চান্ন ডলার ব্যবসায় লাগিয়ে তাকে করে তোলেন বিশাল–বছরে তার আয় হয় বিশ হাজার ডলার। কিন্তু তারপরেই কুয়াশায় সব আচ্ছন্ন হয়ে গেলধ্বংসের কুয়াশা। একবন্ধুকে অনেক টাকা ঋণ দিলেন সে দেউলিয়া হয়ে গেল। একটার পর একটা বিপদ নেমে এল এবার, তার সর্বস্ব নষ্ট হয়ে গেল। মোল হাজার ডলার দেনায় পড়ে গেলেন তিনি। তার স্নায় ভেঙে পড়ল। তিনি আমাকে বলেছিলেন; আমি ঘুমোতে পারতাম না, খেতে পারতাম না। অদ্ভুতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। দুশ্চিন্তা, শুধু দুশ্চিন্তাই আমায় অসুস্থ করে তোলে। একদিন পথে জ্ঞান হারালাম। হাঁটার ক্ষমতাও আমার ছিল না। শয্যাশায়ী হয়ে সারা দেহ ফোড়ায় ভরে গেল। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়লাম। আমার ডাক্তার জানালেন আর মাত্র দুসপ্তাহ বাঁচব। দারুণ আঘাত পেলাম। নিজের উইল তৈরি করলাম, তারপর চুপচাপ শুয়ে শুয়ে শেষের অপেক্ষায় পড়ে রইলাম। আর লড়াই–বা দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। মন হালকা করে ঘুমোলাম। আগে সপ্তাহের পর সপ্তাহ টানা দুঘন্টাও ঘুমোই নি, আর এখন শিশুর মতো ঘুমোলাম। আমার সব ক্লান্তি কোথায় চলে গেল। খিদে হল, ওজনও বাড়তে লাগল।