অবশ্যই কালকের চিন্তা করবেন, কালকের জন্য সাবধানে পরিকল্পনাও করবেন। তবে কোনো দুশ্চিন্তা নয়।
যুদ্ধের সময় আমাদের সামরিক নেতারা ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতেন। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল আর্নেষ্ট জে. কিং বলেছিলেন, আমি আমাদের সেরা সৈন্যদের সব সেরা জিনিসপত্র দিয়েছি, সঙ্গে দিয়েছি সবচেয়ে ভালো কাজের দায়িত্ব। এর বেশি আর কিছু করতে পারি না।
অ্যাডমিরাল কিং আরও বলেন, একটা জাহাজ ডুবে গেলে তাকে তুলে আনতে পারি না। সেটা ডুবতে আরম্ভ করলে আমার শক্তি নেই তাকে ভাসিয়ে রাখি। তার চেয়ে গতকালের কথা না ভেবে আগামীকালের সমস্যা নিয়ে ভাবাই ভালো। তাছাড়া এই দুশ্চিন্তা আমায় পেয়ে বসলে আমি শেষ হয়ে যাব।
যুদ্ধ বা শান্তির সময়, যাই হোক ভালো আর মন্দ চিন্তার তফাৎ হল : ভালো চিন্তার ফলে সঠিক যুক্তিসহ পরিকল্পনা নেয়া যায়। মন্দ চিন্তায় বেশিরভাগই শুধু উদ্বেগ আর স্নায়বিক দুর্বলতা জাগায়।
সম্প্রতি আমি বিশ্বের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দি নিউইয়র্ক টাইমসের’ প্রকাশক আর্থার হেস সালজবার্গারের সাক্ষাৎকার নিই। তিনি আমায় বলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যখন সারা ইউরোপকে গ্রাস করে তিনি ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় প্রায় ঘুমোতে পারেন নি। প্রায় মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে একটা রঙের টিউব ক্যানভাস নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের ছবি এঁকেছেন। অথচ ছবি আঁকার কিছুই তিনি জানতেন না, আসলে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি আঁকতেন। মিঃ সালজবার্গার বলেছিলেন দুশ্চিন্তা থেকে কিছুতেই তিনি রেহাই পাননি যতদিন না একটা চার্চের প্রার্থনা গীতের পাঁচটা শব্দ থেকে তার নীতি গ্রহণ করেন : একপা এগোলেই আমার পক্ষে যথেষ্ট।
পথ দেখাও হে স্নেহময় আলোক….
আমাকে স্থির রাখো : দূরের দৃশ্য আমার চাই না;
এক পা চলাই আমার যথেষ্ট।
ঠিক ওই সময়েই একজন সৈন্য ইউরোপের কোথাও একই জিনিস শিখছিলেন। তার নাম টেড বেনজারমিনো। বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ডের মানুষ সে। দুশ্চিন্তার ফলে তিনি হয়ে যান পয়লা নম্বর এক যুদ্ধ শান্ত মানুষ।
টেড বেনজারমিনো লিখেছেন ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে এতোই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই যে ডাক্তার আমাকে বলেন ‘স্প্যাসমোডিক ট্রান্সভার্স কোলন’ নামে জটিল রোগ হয়েছে। এতে অসহ্য যন্ত্রণা। যুদ্ধ যদি শেষ না হ’ত তাহলে নিশ্চয়ই আমার শরীর একদম ভেঙে পড়ত।
আমার দম প্রায় ফুরিয়ে আসে। আমি ৯৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিসনের নন্ কমিশন্ড অফিসার ছিলাম। আমার কাজ ছিল যুদ্ধে যত লোক নিহত বা নিরুদ্দেশ হয়, তারা মিত্র বা শত্রুপক্ষের যার লোকই তোক তাদের তালিকা তৈরি করা। আমার কাজ ছিল যে–সব মৃতদেহ তাড়াহুড়োয় অগভীর মাটিতে কবর দেওয়া দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন হয়েছিল সেগুলো উঠিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পাঠিয়ে দিতে হত। আমার সব সময় চিন্তা আর ভয় হত বোধহয় মারাত্মক ভুল করছি। আমার দুশ্চিন্তা ছিল সব কাজ সম্পন্ন করতে পারব কি না। আমার ভাবনা হত আমার ষোল মাসের ছেলে–যাকে আমি এখনও দেখিনি তাকে কোলে নিতে পারব কি না। আমার এতই দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তি আসে যে প্রায় চৌত্রিশ পাউন্ড ওজন কমে যায়। আমি পাগলের মতো হয়ে যই, হাত–পা লক্ষ্য করে দেখলাম সেগুলো হাড় আর চামড়া সর্বস্ব। ভাঙা শরীরে বাড়ি ফেরার কথা ভাবলে আতঙ্ক হত ভেঙে পড়ে শিশুর মতই কাঁদতাম। বালজের যুদ্ধের পড় এমন কাঁদলাম যে মনে হল আর স্বাভাবিক হতে পারব না।
শেষপর্যন্ত আশ্রয় পেলাম এক সামরিক ডিসপেনসারিতে। একজন সামরিক ডাক্তার আমায় যে উপদেশ দিলেন তাতেই আমার জীবনে দারুণ পরিবর্তন হল। আমাকে যত্ন করে পরীক্ষার পর তিনি বললেন আমারসব রোগই মানসিক। তিনি এবার বললেন, টেড, আমি চাই জীবনটাকে বালিঘড়ি বলে মনে কর। তুমি জানো বালিঘড়িতে হাজার হাজার বালুকণা থাকে, তারা ধীরে ধীরে যন্ত্রটার ভিতরের ছোট্ট ফুটো দিয়ে পড়তে থাকে। যন্ত্রটা না ভেঙে আমরা একসঙ্গে বেশি বালি ঢোকাতে পারি না। তুমি বা আমি সকলেই ওই বালি ঘড়ির মত। সকালে আমরা কাজ শুরু করার সময় শত শত কাজ থাকে, সে সব একে একে না করে একসঙ্গে করতে গেলে বালি ঘড়ির মতই অবস্থা হবে, তাতে আমাদের শরীর মন ভেঙে পড়বে।
আমি তখন থেকেই সেই স্মরণীয় দিন থেকে, যেদিন একজন সামরিক ডাক্তার আমায় উপদেশ দেন আমি ওই কথা মেনে চলেছি এক সময় এককণা বালি…। যুদ্ধের সময় ওই পরামর্শ আমার শরীর আর মনকে রক্ষা করেছে, আর আজ আমি যে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ডাইরেক্টর সেখানেও সেই উপদেশ আমায় সাহায্য করে চলেছে। এখানেও সেই এক সমস্যা যা যুদ্ধে দেখেছি–অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হবে–আর তা করার সময় কত কম। কত সমস্যা ছিল–স্টক কম, ঠিকানা বদল, অফিস খোলা আর বন্ধ করা, ইত্যাদি। ‘এক সময় এককণা বালি’ ডাক্তার আমায় যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাই আমার কাজে লাগল। বারবার কথাটা স্মরণ করে আমি মানসিক জটিলতা থেকে মুক্ত হয়েছিলাম।
আমাদের বর্তমান জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, আমাদের হাসপাতালের প্রায় অর্ধেক বেড়ই মানসিক আর স্নায়বিক রোগীতে পূর্ণ, যারা অতীত আর আগামীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে ভেঙে পড়ে। অথচ তাদের অনেকেই আজ আনন্দে জীবন কাটাতে পারতেন যদি শুধু তারা যীশুর সেই কথা : আগামীকালের জন্য দুশ্চিন্তা কর না অথবা স্যার উইলিয়াম অসলারের সেই কথা, ‘রোজকার জীবন যাপন কর’ এই কথাগুলো যদি মনে রাখতেন।